সরোয়ার আলম | ২০ অক্টোবর, ২০২২
তবে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। পুলিশে চাকরি পেয়ে দেশের জন্য কাজ করেছি। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সমর্থক নই। যদি সরকারবিরোধী হতাম তাহলে সরকারের আমলে এতদিন চাকরি করতে পারতাম না। তারপর সরকার যেটি ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। এতে আর কিছু বলার নেই।’ একই কথা বলেছেন পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন মিঞা। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। কী কারণে অবসরে পাঠিয়েছে তা বলতে পারব না।’
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপেক্ষা করুন। যারা অপরাধ করবে তাদের শাস্তি পেতে হবেই।
অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না বা হবেও না। সরকারি চাকরি করে অন্যদের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেবেন তা হতে পারে না। পুলিশে যারা এসব করছেন তাদের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তিনজন এসপিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই অবসরে পাঠানো হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, প্রায় ছয় মাস ধরে সরকারবিরোধী পুলিশ সদস্যদের কর্মকা- নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে পুলিশ প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বেড়ে যাওয়ার আগেই বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। সরকারের হাইকমান্ড জানতে পেরেছে, পুলিশে উচ্চ, মধ্যম ও জুনিয়র পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সাজার চেষ্টা করছেন। তাদের কেউ কেউ বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তথ্য সচিব মো. মকবুল হোসেনকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর মধ্যেই হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার পুলিশ সুপার পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, গোপন বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন এমন অনেককেই এখন সন্দেহ করা হচ্ছে। আতঙ্কে অনেকেই তাদের ফেইসবুক বন্ধ ও মোবাইল ফোনের কথাবার্তায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে সরকারের হাইকমান্ড পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে যারা ভিন্নমতাদর্শী এবং সরকারবিরোধী তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে। নির্দেশনা পেয়ে এমন সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশের অতিরিক্ত আইজি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, এডিশনাল এসপি ও ইন্সপেক্টরদের ওপর নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। তাদের দৈনন্দিন চলাফেরা, মোবাইল ফোনে যোগাযোগসহ দেশ-বিদেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে শুধু কর্মরত কর্মকর্তারাই যে ষড়যন্ত্রে জড়িত তাই নয়, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন বলে পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে। তাদের মধ্যে যারা চিহ্নিত, তাদের বিভিন্নভাবে বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তথ্য সচিব ও তিন এসপির বিষয়টি কেন্দ্র করে সবাইকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাদের মধ্যে দোটানা ভাব আছে, তাদের বিষয়ে এটি পরিষ্কার বার্তা বহন করবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার যে তিনজন পুলিশ সুপারকে অবসরে পাঠানো হয়েছে তারা বিএনপি মতাদর্শী হিসেবেই পরিচিত। তারা সরকারবিরোধীদের কাছে তথ্য ফাঁস করেন বলে অভিযোগ আছে। এমনকি তারা দেশবিরোধী কর্মকা-েও যুক্ত। এসব তথ্য হাতে আসার পর পুলিশ সদর দপ্তর হার্ডলাইনে যায়। ইতিমধ্যে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ওই তালিকায় অন্তত ২০০ জনের নাম আছে। তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা আরও বলেন, মাস তিনেক আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি নির্দেশনা গিয়েছিল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিষয়ে খোঁজ নিতে। কিন্তু পুলিশের ভেতরে থাকা একটি চক্র ওই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। যারা এসব করেছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নজরদারির মধ্যে ডিআইজি, এডিশনাল ডিআইজি, এসপি, এডিশনাল এসপি ও থানার ওসি ও ইন্সপেক্টর রয়েছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের সার্বিক কর্মকা-ের ওপর সবসময় নজরদারি করে সরকারের একাধিক সংস্থা। নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের নজরদারি আরও বাড়ানো হয়। নির্বাচনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে ততই ষড়যন্ত্রের আভাস মিলছে। এসব তথ্য পেয়ে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের টেলিফোনেও আড়িপাতা হচ্ছে। তারা কখন কার সঙ্গে দেখা করছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন কি না, তা নজরে রাখছেন গোয়েন্দারা। এমনকি ‘উত্তরা ষড়যন্ত্রের’ মতো কোনো ঘটনার অবতারণা যাতে কেউ করতে না পারেন, সে ব্যাপারেও সতর্ক সরকারের হাইকমান্ড।
পুলিশ সদর দপ্তরের আরেক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি পুলিশে বড় ধরনের কয়েকটি পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার মধ্যে ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭ ও ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা আছেন। এমনকি তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। পাশাপাশি তাদের স্বজনরাও সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এসব অভিযোগ সরকারের হাইকমান্ডে জানানো হয়েছে। এ জন্য তাদের আমলনামা আবারও যাচাই-বাছাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পুলিশের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি হতে পারেন। দায়িত্বরত অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার না করতে পুলিশের সবকটি ইউনিটের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। এর আগেও একই ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশনা না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে খোলস পাল্টে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তা ঢুকে পড়েছেন। তারা আওয়ামী সমর্থক মুখোশ পরে বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দলীয় গুণগান করে সরকারের শীর্ষ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখন আবার তারাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গোপনে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। পুলিশের মধ্যে অনেকে ঘাপটি মেরে আছেন। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র বা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন বলে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। আবার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা আছেন যারা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি বা উত্তরাধিকারভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন কিন্তু এরকম অনেকেই পদোন্নতিবঞ্চিত বা সঠিক মূল্যায়ন পাননি বলে অভিযোগ এসেছে। আর এসব কারণেই শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে।