নগদের সংকট, সঞ্চয় ভেঙে ঋণ পরিশোধ করছে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো মেহেদী হাসান রাহাত

বিদ্যুতের মূল্য বাবদ সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পাওনা অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এতে নগদ অর্থের সংকটে পড়ে গেছে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে নিজস্ব তহবিল ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ থেকে।

এসব ঋণের বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টি দেয়া রয়েছে, যার পরিমাণ এরই মধ্যে অর্ধ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তা সরকারকে বিপাকে ফেলে দিতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষে সরকারের গ্যারান্টেড ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের ১৮ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে গ্যারান্টি দেয়া ঋণের স্থিতি ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। চীন, ভারত, জাপান, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতে এ গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। এ ১৮ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে নয়টির গ্যারান্টেড ঋণের স্থিতি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমলেও বাকিগুলোর বেড়েছে।

আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এপিএসসিএল) অধীনে বাস্তবায়নাধীন আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এইচএসবিসি করপোরেট ট্রাস্টি কোম্পানি (ইউকে) লিমিটেডের অনুকূলে সরকারের গ্যারান্টি দেয়া ঋণের স্থিতি গত ৩০ জুন শেষে ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। একইভাবে আশুগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ঢাকা শাখার অনুকূলে ৬২৯ কোটি ২২ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে।

আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এপিএসসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রকৌশলী মো. শাহ আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ঋণ পরিশোধের সময় বিপিডিবি আমাদের কিছু অর্থ দেয় এবং এর পাশাপাশি আমাদের নিজেদের তহবিলের অর্থ ও ব্যাংকে থাকা স্থায়ী আমানতের অর্থ দিয়ে বিদেশী ঋণের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি।’

বিপিডিবির অধীন শাহজীবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এইচএসবিসির অনুকূলে সরকারের গ্যারান্টি দেয়া ঋণের স্থিতি গত জুন শেষে ছিল ১ হাজার ৭৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে এইচএসবিসি ছাড়াও আইসিবিসি ও এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার ঋণ রয়েছে। বিপিডিবির মালিকানাধীন ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চীনের আইসিবিসি ব্যাংকের অনুকূলে গ্যারান্টেড ঋণের স্থিতি ১ হাজার ৮০ কোটি ১১ লাখ টাকা।

বিপিডিবির মালিকানাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১০০ মেগাওয়াট এইচএফও বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে এইচএসবিসির অনুকূলে ৪৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট পুনর্বিদ্যুৎ প্রকল্পে এইচএসবিসির অনুকূলে দেয়া ঋণ গ্যারান্টির পরিমাণ ১ হাজার ৭৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ৪০০ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা-৩ গ্যাসভিত্তিক সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে জাপানের জেবিআইসির অনুকূলে ১ হাজার ৪৭২ কোটি ১০ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার অনুকূলে সরকারের গ্যারান্টি দেয়া ঋণের স্থিতি ৩০ জুন শেষে ছিল ২ হাজার ২৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সৈয়দপুরের ১৫০ মেগাওয়াট ডিজেলভিত্তিক সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ব্যাংক অব চায়নার অনুকূলে ২৮৭ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে।

বিদেশী ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির সদস্য (অর্থ) সেখ আকতার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা মোটামুটিভাবে বিদেশী ঋণগুলো নিয়মিত পরিশোধ করছি। এক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। তবে এতে অন্যদের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে।’

রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও পাওয়ারজেন কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন কড্ডা ১৫০ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চীনের আইসিবিসি ব্যাংকের জিয়াংশু শাখার অনুকূলে ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। আরপিসিএলের অধীন ময়মনসিংহের ৩৬০ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক সিসিপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যাংক অব চায়নার অনুকূলে ২০৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। আরপিসিএল-নরিনকোর (আরএনপিএল) অধীন পটুয়াখালীর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার অনুকূলে ৪ হাজার ৬০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। বিপিডিবি-আরপিসিএল পাওয়ারজেন কোম্পানি লিমিটেডের অধীন শ্রীপুর ১৫০ মেগাওয়াট ডিজেলভিত্তিক সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জার্মানির একেএ ব্যাংকের অনুকূলে ৫৫৯ কোটি ২৪ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে।

বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) আওতাধীন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার অনুকূলে ১৬ হাজার ৯০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) অধীন রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অনুকূলে ১৪ হাজার ৮২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে অর্থ সংকটের কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার দাম ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল বিসিপিসিএল।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে সরকারের বড় অংকের বিল দেনা হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুসারে সরকার বিদ্যুৎ কিনলেও এর বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারকে কিছু অর্থ পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে হবে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে, সরকার এটি কীভাবে সমাধান করবে সেটি এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আমরা তো সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি সব ঋণদাতার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঋণ পুনর্গঠন করার জন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রম ক্ষয় যেভাবে হোক বন্ধ করতে হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে এটি অর্থবছর শেষে ১২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। এ অবস্থায় ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি পিছিয়ে দিতে হবে যাতে সরকার কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাচতে পারে।’

বড়পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্প্রসারণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের জন্য চীনের আইসিবিসি ব্যাংকের অনুকূলে সরকারের গ্যারান্টি দেয়া ঋণের স্থিতি গত ৩০ জুন শেষে ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।  নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) অধীন সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি (দ্বিতীয় ইউনিট) প্রকল্পে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ঢাকা শাখার অনুকূলে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকার ঋণ গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। এনডব্লিউপিজিসিএলের মালিকানাধীন সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি (তৃতীয় ইউনিট) প্রকল্পে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ঢাকা শাখার অনুকূলে দেয়া ঋণ গ্যারান্টির পরিমাণ ১ হাজার ৩৩৬ কোটি ১১ লাখ টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে সরকারের ব্যয় এমনিতেই বেড়েছে। তার ওপর সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে অর্থ সরকারকে পরিশোধ করতে হবে এবং এতে সরকারের ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে।

সরকারের সাবেক অর্থ সচিব ও সাবেক মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের বিদেশী ঋণের পোর্টফোলি বর্তমানে এমনিতেই অনেকে বেড়ে গেছে, যা ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। স্থানীয় মুদ্রা টাকার ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশী ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় বাড়বে। বর্তমানে বিভিন্ন ঋণের কিস্তি পরিশোধে দেরি হতে দেখা যাচ্ছে। এতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার যেসব গ্যারান্টেড ঋণ রয়েছে, সেগুলো খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। যেসব ঋণের ক্ষেত্রে সরকার গ্যারান্টি দিয়েছে সেগুলো হচ্ছে সরকারের কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটি। কিন্তু সংস্থাগুলোর খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কারণে এটি সরকারের প্রকৃত দায় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। রিজার্ভের ক্রম ক্ষয় বন্ধ করতে আমরা অনেক কিছু সীমিত করছি, এমনকি ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যারান্টেড ঋণ যদি খেলাপি হয়ে যায় তাহলে সরকারকে এটি পরিশোধ করতে হবে। তাতে সরকারের বিদ্যমান যেসব ঋণ রয়েছে, তার সঙ্গে এগুলোও যোগ হবে। এতে সরকারের ব্যয় আরো বাড়বে। ফলে সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতির অসামঞ্জস্যতা বাড়বে।’

সূত্র : বনিক বার্তা