দ্রুত নির্বাচন দ্রুত পতনেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে

দ্রুত নির্বাচন দ্রুত পতনেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে

কাকন রেজা

সমন্বয়ক, উপদেষ্টা সবাইকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। হ্যাঁ, করা হচ্ছে, মানে তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কেন করা হচ্ছে? অনেকে বলবেন, এই সরকারকে বিতর্কিত করতে। না ভাই, এটাই একমাত্র বা মূল উদ্দেশ্য নয়। প্রশ্ন করতে পারেন মূল উদ্দেশ্য নিয়ে। বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব ও আগস্ট ভিক্টোরির পর ফ্যাসিজমের রাজনৈতিক পুনর্বাসন অসম্ভব, যদি জুলাই বিপ্লবের ঘটনাবলি দৃশ্যপটে থাকে। আর সেই দৃশ্য সমূহ অদৃশ্য করা গেলেই তা সম্ভব। সরকারের হানিমুন পিরিয়ডের মধ্যেই যদি তা সম্ভব হয় তাহলে সবচেয়ে ভালো। তিন মাস একটা সরকারের হানিমুন পিরিয়ড। তিন মাস পূর্ণ হয়েছে এই সরকারের। এই সময়ের মধ্যেই উঠেছে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক।

এখানেও প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থেকেও তো বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভাইরে, এদেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই বিভিন্ন শক্তির স্টেক হোল্ডার রয়েছে, তাদের উইং রয়েছে। যারা ‘এসপিওনাজ’ সম্পর্কে জানেন, তারা বোঝেন কীভাবে এই উইং অ্যাক্ট করে। সেই উইং এই বিতর্ক সৃষ্টি করছে, তার সাথে কেউ না বুঝেই কোরাস ধরেছেন। এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের। তিনি এ পর্যন্ত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তার ম্যাচিউর পলিটিক্যাল অবস্থান দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করার কারণ। তাই তিনি পরিষ্কার বলেছেন, বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ হতে না দেওয়ার কথা। কিন্তু তার বার্তা তার দলের সবার মর্মে পৌঁছেছে কিনা জানি না। পৌঁছলে নানান রকম বিতর্কিত কথা বলতেন না কোনো কোনো নেতা।

এই অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে মিলিটারির সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের মিলিটারিকে জনগণ এখনো তাদের পক্ষের শক্তি হিসেবে ভাবে। তারা ভাবে, সেনাবাহিনী জনগণকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা করবে। জুলাই বিপ্লব তার প্রমাণ। অনেকবারই এমনটা ঘটেছে বলেই এই আস্থা রয়েছে জনগণের। সুতরাং এই সরকারকে যারা দুর্বল ভাবেন, তাদের চিন্তাশক্তি দুর্বল। কিন্তু যারা বিশেষ কোনো শক্তির হয়ে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন, তারা সেনাবাহিনীকে ভয় পান। তারা জানেন সেনাবাহিনী থাকলে ফ্যাসিজমের আড়ালে তাদের প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা সংস্কার বিষয়ক আলাপের ওপর দ্রুত নির্বাচনের আলাপ তোলায় কাজ করছেন।

দ্রুত নির্বাচনের বিষয়টি কেন তুলছেন, সেই ব্যাপারটা বলি। সংস্কার না হলে সকল প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফ্যাসিজমের ভূত রয়ে যাবে। দ্রুত নির্বাচন দিলে সংস্কার যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ভূতের অপসারণও সম্ভব নয়। নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসলে সেনাবাহিনীকেও ব্যারাকে ফিরতে হবে। ফলে মাঠ থাকবে অরক্ষিত। পুলিশের মনোবল, লোকবল ফিরতে আরও সময় লাগবে অন্তত এক বছর। সিভিল প্রশাসনে রয়েছে ভূত। সবমিলিয়ে নির্বাচিত সরকারকে বিতর্কিত করে ফেলে দেওয়া হবে খুবই সহজ। মাঠে পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হবে না পুরোপুরি, তার ওপর প্রশাসনের ভূতেরা তৎপর হবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়। তারা মরণকামড় দেবে। যোগফল দাঁড়াবে ফ্যাসিজমের প্রত্যাবর্তন। খুব সংক্ষেপে লিখলাম। এর ব্যাখ্যা দিতে গেলে রীতিমতো গবেষণাপত্র হয়ে যাবে।

গবেষণা থাক, খুব ক্ষুদ্র কয়েকটা লক্ষণ ধরিয়ে দিই গত গত কিছুদিনের ঘটনায়। সমন্বয়ক ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে পূর্বাপর না জেনে করা হয়েছে তুলকালাম। আহতদের উস্কে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে সরকার বিপ্লবীদের জন্য কিছুই করছে না। এদিকে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। মোহাম্মদপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই বেড়েছে। আজিমপুরে সকাল বেলায় ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা ডাকাতি করেই ক্ষান্ত হয়নি, একটা শিশুকেও অপহরণ করেছে। চট্টগ্রামের এলোপাথাড়ি গুলিতে বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর দিয়েছে গণমাধ্যম।

এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গণমাধ্যম বলছে, এই গুলির ঘটনা বিএনপির দলীয় কোন্দলের কারণে। মোদ্দাকথা, একটা অ্যানার্কি, প্যানিক সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। কিছুটা সফলতাও এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের যে মূল কাজ সংস্কার, এসব কারণে তা বিলম্বিত হচ্ছে। বলতে পারেন, সংস্কারকে বাধা দিতেই এসব করা।

সারাদেশেই বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকাশ্য হচ্ছে। এখানেও প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তারা ক্ষমতায় আসলে একই কাজ করবে। ইতোমধ্যেই বিএনপির জনপ্রিয়তাও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। অর্থাৎ বিপ্লব পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে যেভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে তেমনি আগাম বিতর্কিত করে রাখছে সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকেও। বিএনপিকে বিতর্কিত করার কারণ আগেই বলেছি এবং আবার বলছি। বিএনপি যদি দ্রুত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসে, তাহলে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব, সাথে পুলিশের পূর্ণশক্তি না থাকা, প্রশাসনে ফ্যাসিজমের ভূত এই তিন চক্রের সহযোগিতায় বিএনপিকে নামানো খুব কঠিন হবে না। ওহ, আরেকটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি। বিএনপির সাথে জুলাই বিপ্লবের কারিগর তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টাও প্রবল ভাবে দেখা যাচ্ছে। বিএনপিপন্থী কোনো কোনো একটিভিস্টের কার্যক্রমের দিকে তাকালেও তা বোঝা যায়। এতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে বিএনপি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। গত সতেরো বছরে চরম নির্যাতিত দলটির জনপ্রিয়তা ধ্বংসে এই ফর্মুলাতেই কাজ করছে ফ্যাসিজমের প্রেতাত্মারা।

দ্রুত নির্বাচনের পেছনে আরেকটা বিষয়ও আলোচিত হচ্ছে। যদিও এই আলোচনা প্রবল নয়, তাও ফেলে দেওয়ার কথা ভাবা বোকামি হবে। ধরুন, তারেক রহমানের ফিরতে বিলম্ব হবে। যারা চান, তারা কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় তারেক রহমানের ফেরাকে বিলম্বিত করবেন। সেক্ষেত্রে যদি তিন বা চার মাসের মধ্যে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? প্রশ্নটা উঠছে, এটাকে নজরআন্দাজ করা বোকামি হবে। কারণ একটা পক্ষ তারেক রহমানের ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বের কথা জানেন। তারা জানেন তারেক রহমানকে কাবু করা সহজ নয়, কিন্তু অন্যদের সহজ। যুক্তি বলে তারা সহজ পথেই পা বাড়াবেন।

আমরা যারা উপসম্পাদকীয়সহ প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখি, তারা মূলত ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই লিখি। সম্ভাবনার কথা লিখি, সম্ভাব্য বিপদের কথা লিখি। মানুষের চিন্তার জায়গাটাকে নাড়া দিতে লিখি। তবে সব সম্ভাবনাই সত্যি হবে তা কিন্তু নয়। সত্যি না হলেও সম্ভাবনাগুলোকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আর সত্যি হতে পারে এমন সম্ভাবনাগুলো মোকাবেলা যেন সহজ হয় সেজন্যই আমাদের লেখা। আমরা সমাধান করতে পারি না, সাবধান করতে পারি। সাবধান হওয়া ও সমাধান করা রাজনীতিবিদসহ অন্য যারা সরকারের অংশ তাদের কাজ। শেষে পরিষ্কার ভাবে বলি, দ্রুত নির্বাচন দ্রুত পতনেরও কারণ হতে পারে। সুতরাং সাবধান হওয়া জরুরি।

Bangla Outlook