দেশে দিনদিন বেড়েই চলেছে দ্রব্যমূল্য। ক্রমাগত বাড়তে থাকা পণ্যমূল্যে ধুঁকছে নিম্ন আয়ের মানুষ। আগস্টে প্রধান খাদ্যদ্রব্যগুলোর বৈশ্বিক মূল্য দুই বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছালেও, বাংলাদেশে এই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৪%, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯.৯২%।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটুকু খাবার প্রয়োজন, তা যোগাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে এ শ্রেণির মানুষকে। কিভাবে চলছেন তারা?
মুচি রামপ্রসাদ
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গেটের কোণায় রামপ্রসাদের বসার জায়গা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে বসেই জুতা সেলাই করেন। সারাদিনের কাজ শেষে হাতে থাকে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা।
মধ্যবয়সী লোকটি থাকেন রাজধানীর গোপীবাগের ভাড়া বাসায়। মা, স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে এক ঘরেই বসবাস। ঘরের ভাড়া ছয় হাজার টাকা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি তিনি।
ছয়-সাত বছর আগের তুলনায় বর্তমানে কয়েকশো টাকা দৈনিক রোজগার বেড়েছে রামপ্রসাদের। কিন্তু আগের চেয়ে তার জীবন এখন অনেক কঠিন। কোনো কোনো দিন পরিবার নিয়ে থাকতে হয় না খেয়েও। তার ভাষ্যে, ‘আগে ইনকাম হয়তো কম ছিল, কিন্তু তখন চলছি ভালো। জিনিসপত্র সস্তা ছিল, সবকিছু মোটামুটি কিনতে পারছি।’
নিত্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দামের কথা উল্লেখ করে বলছিলেন, ‘পোল্ট্রি মুরগির মাংস ছয় মাসেও একবার খাওয়া পড়ে না। খাসির মাংসের কথা তো চিন্তাও করি না। যেইডা গরীবেরা খাইতাম, নিম্নতম খাবার, পাঙ্গাস মাছ, তেলাপিয়া মাছ- এডিরও আমরা ধারেকাছে যাইতে পারি না এহন। বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য ডিম কেনারও উপায় নাই। সবজির দামও অনেক। ভালোগুলা তো কিনতে পারি না। আলু-টালু যেগুলা নষ্ট আলাদা কইরা রাখে, ওইডা কিনা আনতে হয়।’
ঘরে বৃদ্ধা মা অসুস্থ, স্ত্রীর শরীরও দুর্বল খুব। লো প্রেশারের কারণে প্রায়ই মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। রামপ্রসাদ নিজেও ভুগছেন হার্টের অসুখে। কিন্তু চিকিৎসা করানোর সাহস করে উঠতে পারেন না। হাসপাতালের সামনে বসে কাজ করেন বলে ডাক্তার হয়তো সহজেই দেখাতে পারবেন, কিন্তু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপত্র কেনার ক্ষমতা নেই বলে টিকে থাকতে হয় শরীরকে পাত্তা না দিয়েই।
বড় দুই মেয়ের বিয়ের সময় ঋণ হয়েছে অনেক। প্রতি মাসেই ধারদেনায় চলতে চলতে এখন তার ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকায়। তিন দশক আগে হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে এসে রাজধানীতে জীবিকার খোঁজে আশ্রয় নেওয়া রামপ্রসাদের রোজ কাটে পরের দিন খেতে পাবেন কি না সেই দুশ্চিন্তায়।
ভেলপুরি বিক্রেতা মুজিবুর রহমান
রোজ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ভেলপুরি বিক্রি করেন মুজিবুর রহমান। স্কুল ছুটির পর কাজে বিরতি নিয়ে বাসায় ফিরেন কিছুক্ষণের জন্য। এরপর আবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বসেন হাতিরঝিলের পাশে। দুইবেলা ভেলপুরি বিক্রি করে মুজিবুরের দৈনিক আয় হয় হাজার-বারোশো টাকার মতো।
দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। মেয়েটা এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ইস্পাহানী বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে, ছেলেটা উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজে।
পরিবার নিয়ে দিলুরোড এলাকায় সাবলেট থাকেন মুজিবুর রহমান। সব বিলসহ মাস শেষে বাসা ভাড়া দিতে হয় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। মেয়ের স্কুল আর প্রাইভেটের মাসিক বেতনে যায় ছয় হাজার টাকার মতো। ছেলের প্রায় তিন হাজার টাকা। মাসের বাকি সব খরচ চালাতে প্রতিনিয়তই হিমশিম খেতে হয় মুজিবুরকে।
‘কোনোরকমে বাঁইচা আছি এইখানে। ঢাকা শহরে থাকতে গেলে সব খরচই বেশি। অন্যকোনো খরচ তো কমানোর উপায় নাই, খাবার-দাবারেই যত কমানো যায়। শাক, ডাল বা অন্য সবজিই কিনি বেশি। সপ্তাহে একদিন হয়তো তেলাপিয়া মাছ কিনতে পারি। ছয় মাস আগে মুরগি খাওয়া হইছিল, বাসায় মেহমান আসা উপলক্ষে। কুরবানির ঈদ ছাড়া গরু চোখে দেখার সুযোগ নাই। জীবনের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা,’ বলছিলেন মুজিবুর।
আট বছর আগে ভেলপুরির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তখনের চেয়ে এখন সব কাঁচামালের দাম অন্তত তিনগুণ বেড়েছে বলে জানান তিনি। আটবছর আগের ও পরের দাম তুলনা করে বলেন, ‘টক বানাই যে তেঁতুলটা দিয়া এইডার দাম ছিল ৫৫ টাকা কেজি, এখন এইডা কিনি ১৫০ টাকায়। এক কেজি শুকনা মরিচ কিনতাম ১৭০ টাকায় আর এখন এইডার দাম ৪৪০ টাকা। পুরিগুলা আগে কারখানা থেইকা কিনতাম ৭০ পয়সা-১ টাকা পিস কইরা। এখন তিন টাকা হয়া গেছে।’
নিজে কষ্ট করে হলেও ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের পড়ালেখায় কখনো ছাড় দিতে চাননি মুজিবুর রহমান। কিন্তু দিন দিন দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত পরিবার নিয়ে শহরে টিকে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়েই এখন সন্দিহান তিনি।
রিকশার চাকায় দুলাল শেখের কঠিন জীবন
‘যখন জমা খরচ ২০ টাকা ছিল, তখন থেইক্যা রিকশা চালাইতেছি। এখন রিকশার জন্য প্রতিবেলা জমা দেই ৭০ টাকা। দুই বেলা মিলাইয়া অখন খরচ হয় ১৪০ টাকা। আরো খরচ তো আছেই,’ বলছিলেন রিকশা চালক দুলাল শেখ। গত ৩৩ বছর ধরে ঢাকা শহরের অলিগলিতে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।
গত ৩৩ বছরে দুলাল দেখেছেন ঢাকার অনেক উত্থান-পতন। শহুরে জীবনে আয়-ব্যয়ের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে হাপিত্যেশ করেছেন বহুবার। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার খরচের পাশাপাশি জীবনমানের ব্যয় সবই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গত কয়েক বছরে। সবশেষে চলতি বছরের খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির (১২.৮২ শতাংশ) সাথে তাল মিলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি কী- তা বোঝেন না দুলাল। কিন্তু বোঝেন খাবারের দাম বেড়েছে। তাই অনেকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেই বলেন, ‘মাছ, আলু, ডিমের দাম আগের থেইক্যা অনেক বাড়ছে।’
দুলাল শেখের রিকশা চালানো শুরু অভাব থেকেই। ১৯৮৯ সালের শেষদিকে জামালপুর থেকে প্রথম ঢাকা শহরে আসেন তিনি। নিরিবিলি জামালপুর ছেড়ে মনে খানিকটা খেদ নিয়েই ব্যস্ত শহর ঢাকায় পা রেখেছিলেন। মাথায় তখন অজস্র চিন্তা। একে তো পরিবার ছেড়ে নতুন জায়গা, তার উপর খুঁজতে হবে কাজ। শহর থেকে অর্থ উপার্জন করে পাঠাতে হবে পরিবারের কাছে।
নব্বই দশকের শুরুতে ঢাকায় কাজ খুঁজতে এসে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিলো তাকে। পড়ালেখার ডিগ্রিও সেভাবে ছিল না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পারিবারিক অনটনে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করতে পারেননি। জামালপুরে থাকাকালীন যদিও বাবাকে মাঠের কাজে সাহায্য করতেন, কিন্তু তাতে সংসারের অভাব কিছু কমেনি। তাই বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসা আর এখানেই জীবিকার অবলম্বন হিসেবে সঙ্গী করেন রিকশাকে।
গত ৩৩ বছরে রিকশার চাকার সাথে সাথে ঘুরেছে দুলালের জীবনের চাকাও। পরিবার বড় হয়েছে, চুল দাঁড়িতেও পাক ধরেছে। কিন্তু খরচের খেরো খাতায় আয় ব্যয়ের হিসাব যেন মিলতেই চাইছে না। যাপিত জীবনের হিসাব মেটাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে তার।
দুলাল শেখ ঢাকায় বর্তমানে একাই থাকেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ের দিকে একটি সাবলেটে থাকেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের বাকি সদস্যরা থাকেন জামালপুরে।
রিকশা চালিয়ে প্রতি মাসে ১২-১৩ হাজার টাকা উপার্জন করলেও খরচের দিক থেকে তা দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ঢাকায় নিজে থাকার জন্য ৪ হাজার টাকা আর কিছুটা হাতখরচ রেখে বাকিটা পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। তাতেই চলছে দুলালের সংসার।
ঢাকায় থাকার জন্য এই ৪ হাজার টাকায় কোন কোন খাতে খরচ নির্বাহ করেন, তা জানতে চাইলাম দুলাল শেখের কাছে। দুলাল বলেন, ‘আমি ফ্যামিলির খরচ, নিজের খরচ, ঘর ভাড়া, ভাতের বিল, গোসলের জন্য পাম্পের বিল দেই। পাম্পে গোসল করলে মাসে ৪৫০ টাকা লাগে। দুইবেলায় ভাতের বিল মিলায়ে মাসে ৩ হাজার টাকা দেই। সিট ভাড়া দেই ৫০০ টাকা। সব মিলাইয়া ৪ হাজার থেকে ৫০ টাকা কম।’
অর্থাৎ, খাবার পিছু দুলালের দুপুর আর রাতের জন্য নির্ধারণ থাকে দৈনিক ১০০ টাকা। তবে সকালের খাবারের হিসাব আলাদা। অধিকাংশ দিন সকালে চা-বনরুটি খেয়েই কাটিয়ে দেন দুলাল। তাতেও দৈনিক ২০ থেকে ২৫ টাকা খরচ হয়। ঢাকা শহরে থাকতে গিয়ে দুলালকে গুণতে হয় গোসলের হিসাবও। পাম্পে গোসল বাবদ দৈনিক খরচ হয় ১৫ টাকা। সিট ভাড়া বাবদ প্রতিদিনের খরচ হয় ১৬.৬৭ টাকা।
দৈনিক থাকা, খাওয়া গোসল বাবদ দুলালের খরচের তালিকায় থাকে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। যদি একবেলা রিকশা চালান তাহলে খরচের ফর্দে যোগ করতে হয় ৭০ টাকা আর দুইবেলা রিকশা চালালে আরো ১৪০ টাকা।
দুলালের খরচ প্রতিদিন নির্ধারিত থাকলেও আয় প্রতিদিনের ভিত্তিতে হচ্ছে না। কোনো কোনোদিন অসুস্থ থাকলে কাজেও যেতে পারেন না। সেদিন আয় না হলেও খরচ কিন্তু ঠিকই হয়।
রিকশাচালক হিসেবে ৩৩ বছরের জীবনে রিকশা ভাড়া অনেকবার বাড়লেও বাড়েনি দুলালের আয়। বরং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরচ। যাত্রীর সাথেও ভাড়া নিয়ে বচসা লেগে থাকে নিত্যদিন। তার উপরে শহরে বেড়েছে রিকশাচালকের সংখ্যা। প্রতিযোগিতা ও নানান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েই প্রতিদিন লড়াই করে যাচ্ছেন দুলাল শেখ।
টাকা পয়সার সংকট নিয়ে বাড়ি থেকেও নানান সময়ে আসে অভিযোগ। বছর কয়েক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আপ্যায়নের দিকেও তাই তাকে খেয়াল রাখতে হয় নিয়মিত।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার উপায়ও বাতলেছেন দুলাল শেখ। দুলাল বলেন, ‘এই বছর আমি ৫০ টাকা কেজি আলু কিনছি। তবে এমন ভুল আর জীবনে হবে না। কেমনে হবে না? পরের সিজনে বিশ কেজি, চল্লিশ কেজি অথবা এক মণ আলু কিন্যা দেশে ফালায়ে রাখমু’।
পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাইলাম, বেশি আলু কিনে রাখলে তো নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বীরের মতো হেসে দুলাল শেখ উত্তর দেন, ‘খাটের নিচে বালু শুকায়ে আলু থুয়ে দিলে অমনেই থাকবো। আলু নষ্ট হইবো না।’