- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০১ মার্চ ২০২৩, ১৮:৫৩
নতুন নাগরিত্ব আইন করার প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন ধরেই। সেটা হলে হয়ত আরো কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
মন্ত্রিপরিষদ সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) নতুন করে আরো ৪৪টি দেশকে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধার আওতায় এনেছে। এর আগে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার ৫৭টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা ছিল। সেগুলোও বহাল রাখা হয়েছে। তাই সব মিলিয়ে এখন ১০১টি দেশের জন্য এই সুবিধা দেয়া হলো। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রেখেই ওই সব দেশের নাগরিকও হওয়া যাবে। তবে এজন্য আবেদন করতে হবে। নতুন ৪৪টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, লাতিন আমেরিকার ১২টি, ক্যারিবীয় অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের একটি দেশ রয়েছে।
যারা দ্বৈত নাগরিক হতে পারবেন
সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যরা অন্য দেশের নাগরিক হতে পারবেন না। সরকারি কর্মকর্তারা অন্য দেশের নাগরিকদের বিয়েও করতে পারবেন না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন ছোট বিভাগের উপ-সচিব আলীমুন রাজীব জানান, ‘বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেয়, তাহলে কোনো কোনো দেশে শপথ নিতে হয়, আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। তখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থাকে না। তখন তিনি যদি আবার আবেদন করেন, তাহলে বাংলাদেশ সরকার তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। দ্বৈত নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট দেয়া হয়। সেটা দিয়ে তিনি পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র সব কিছুই করতে পরে। অর্থাৎ, তিনি বাংলাদেশেরও নাগরিক। তখন নাগরিকের সব অধিকার এবং সুবিধা তার প্রাপ্য।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া কয়টি দেশের নাগরিকত্ব তিনি নিতে পারবেন, সেটা দেখার বিষয় নয়, তার দরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রাখা। তিনি সরকার নির্ধারিত এক বা একাধিক দেশের নাগরিকত্ব নিতে পারবেন।’
সাধারণ নিয়মের বাইরে সরকারি কর্মকর্তাসহ সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা আলাদা আইন আছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ওই আইনগুলোও দেখা হয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরি আইনে সরকারি কর্মকর্তারা দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পান না। সংসদ সদস্যরা সংবিধান ও রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও) অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিক হতে পারেন না।’
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘বিচাপতিদের দ্বৈত নাগরিকত্বে কোনো বাধা নেই। আমি নিজেও দ্বৈত নাগরিক। সাবেক বিচারপতি ঈমান আলীও দ্বৈত নাগরিক। কারণ, সংবিধানে বিচারপতিদের যোগ্যতার ব্যাপারে বলা হয়েছে তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। আর কিছু বলা নেই। অন্যদিকে সংসদ সদস্য হলে তারা অন্য দেশের নাগরিক হতে পারবেন না বা অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে পারবেন না। তাই দ্বৈত নাগরিকরা সংসদ সদস্য হতে পারেন না। দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে সেটা ত্যাগকরতে হবে।’
দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা-অসুবিধা
ইমিগ্রেশন আইনজীবী ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন বলেন, ‘দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা অনেক। যদি বাংলাদেশের কেউ বিদেশী নাগরিকত্ব নেয়ার পর তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকে, তাহলে বাংলাদেশে তার আর কোনো নাগরিক অধিকার থাকে না। এখানে সম্পত্তির অধিকারই বড়। সম্পত্তি কিনতে পারে না। আবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়। দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে দু‘দেশেই তিনি সব নাগরিক অধিকার পান। দুটি দেশই তার দেশ। আবার সন্তানরা যদি বিদেশী নাগরিক হয়, তাহলে তাদের বাংলাদেশের অধিকার পেতে সমস্যা হয়। দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান সেটা দূর করেছে।’
তিনি আরো জানান, দ্বৈত নাগরিকত্ব না থাকলে বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়।’ অন্যদিকে, দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে একজন ব্যক্তি একাধিক দেশের পাসপোর্ট রাখতে পারেন। দু‘দেশে আসা-যাওয়ায় কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না বলেও জানান তিনি।
লন্ডনে বসবাসরত বুলবুল হাসান বাংলাদেশ ও ব্রিটেন দু‘দেশেরই নাগরিক। তিনি বলেন, ‘দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধার কারণে আমার পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকয়্যার্ড’ সিল আছে। এখন বছরে যখন প্রয়োজন আমি দেশে আসতে পারি। সেখানে পরিবারের লোকজন আছে। দু‘দেশেই আমার সম্পদের মালিকানা আছে। আমি দু‘দেশেরই নাগরিক।’
যারা বিনিয়োগকারী, তারাও সুবিধা পান। দু‘দেশেই তারা নাগরিক হিসেবে বিনিয়োগ করতে পারেন, সম্পদ অর্জন করতে পারেন। বিদেশী হিসেবে এটা করার ক্ষেত্রে অনেক আইনি ঝামেলা হয় বলেও জানান তিনি।
বুলবুল হাসান বলেন, ‘ভারতীদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা আছে। এমনকি ঋষি সুনাকের স্ত্রী এখনো ভারতীয় নাগরিক। তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি এমনো দেখেছি, এখানে কেউ কেউ আছেন, তারা চার পাঁচটি দেশের নাগরিক। এই সময়ে একক নাগরিকত্বের বিধান কোনো দেশে থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি।’
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দ্বৈত নাগরিকত্বের দেশ কোন প্রেক্ষাপটে সরকার বাড়াল তা নিয়ে ভাববার আছে। কারণ এটা নিয়ে আদালতে একটি মামলা চলছে।’
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘কানাডার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন এক বাংলাদেশী বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে ব্যবসা করছেন। তিনি বাংলাদেশে আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছেন। আদালত এমিকাস কিউরি হিসেবে এই মামলার শুনানিতে আমাকে ডেকেছিলেন। আমার কথা হলো, এতে সাধারণ নাগরিকদের হয়ত সুবিধা হবে, কিন্তু দেশ থেকে অর্থ পাচারও বেড়ে যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারা দেশে ফিরে জমি বিক্রি করবেন, ব্যবসা করবেন, টাকা আরেক দেশে নিয়ে যাবেন। কারণ, তিনি দু‘দেশেরই নাগরিক।’
তার মতে, ‘ভেবে দেখতে হবে কাদের সুবিধা দেয়ার জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের দেশের সংখ্যা আরো বাড়ানো হলো। অনেকেই দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে বাড়ি-গাড়িসহ অনেক সম্পদ করেছেন। দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধায় তারা হয়ত সেটা হালাল করতে পারবেন।’
উল্লেখ্য, সার্কভুক্ত দেশ এবং মিয়ামারের সাথে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা নেই বাংলাদেশি নাগরিকদের।
সূত্র : ডয়চে ভেলে