দোলাচলে দর্জি অর্থনীতি

  • খন্দকার হাসনাত করিম
  •  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৪৯, আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৫০
দোলাচলে দর্জি অর্থনীতি – ফাইল ছবি

চলতি অর্থবছরে দেশের রফতানি আয়ের পাঁচ হাজার ৫২ কোটি ডলারের মধ্যে চার হাজার ২৬৩ কোটি ডলার অর্জিত হয়েছে রফতানিমুখী তৈরী পোশাক শিল্প খাত থেকে। অর্থাৎ বিগত দশকগুলোর রফতানি পারঙ্গমে প্রধান হিস্যাদার হিসেবে তৈরী পোশাক শিল্প শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। এ সময়ের বাকি ৭৮৯ কোটি ডলার রফতানি আয় এসেছে অন্যান্য পণ্য ও সেবাখাত থেকে। অথচ বর্তমান জগৎজোড়া নেতিবাচক অর্থনৈতিক পারঙ্গমের অভিঘাত সেই প্রধান রফতানি খাতের (তৈরী পোশাক) ওপর আছড়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাশিয়ার-ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে গোটা জগতের অর্থনীতিতে মন্দা ডেকে এনেছে এবং যার প্রতিক্রিয়া আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ গৌরব ফলক তার সুনাম ও সুকৃতি ধরে রাখতে না পারার শঙ্কা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর প্রভার পড়বে মৌলিক বস্ত্র উৎপাদন, ডাই-কেমিক্যাল, অ্যাকসেসরিজ বা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে, সর্বোপরি, শ্রম খাতে।

বাংলাদেশে এই একমাত্র রফতানিমুখী শিল্প খাত যেখানে নিরাপদ উৎপাদন পরিবেশ এবং নারীর শ্রমমর্যাদার এক নতুন বাতাবরণ ঘটেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিদেশে এমনিতে এ দেশের পোশাক কেনার হার কমছে। গ্রীষ্মের পোশাক চাহিদা ফুরানোর আগে যারা শরৎ ও শীতের নব নব পরিধান বৈচিত্র্য নিয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়ত, তাদের ক্রয়াদেশ বা অর্ডারে সেখানে সঙ্কোচন লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধান রফতানি খাত তৈরী পোশাক নতুন করে বিপদে পড়লে কী হবে আমাদের রফতানি বাণিজ্যের? এমনিতে উৎপাদন খরচ, যেমন বর্ধিত মজুরি, গ্যাস, বিদ্যুৎ খরচ তীব্র এবং তার উপর প্রবাহে অনিয়ম। এর উপর যদি ক্রেতাদের আগ্রহে ঘাটতি দেখা দেয়; তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে এ খাতে। ‘ডব্লিউটিও’ রেজিমে ঢোকার মধ্য দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক কোটা ব্যবস্থারও বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন যদি বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে তাহলে দেশে কোটি কোটি গজ কাপড় উৎপাদন সক্ষমতাও মুখ থুবড়ে পড়বে।

পোশাক না হয় রফতানি করা যায়, তাই বলে থান কাপড় তো কেউ আমদানি করবে না বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম দরে অনেক বেশি মানসম্পন্ন কাপড় তারা পাচ্ছে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মিসর বা উরুগুয়ে থেকে। তুলা তাদের নিজস্ব। প্রযুক্তিও বিশ্বমানের। আমাদের তুলা কিনে এনে কাপড় বানাতে হয়। কী করে আমরা দরে প্রতিযোগিতা করব তাদের সাথে? তৈরী পোশাকের ওপর বেশি ভরসা করে আমরা ভুল করেছি কি তাহলে? অবশ্য বিকল্প আর রফতানি আয় বাড়ানোর উপায়ই বা কী ছিল? ওষুধ, চামড়া, চামড়াজাত দ্রব্য, হালকা প্রকৌশল বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উপায় ছিল। তবে এসব খাতে রফতানি পারঙ্গম বাড়াতে যা করার দরকার ছিল তা তো আমরা করিনি। একবারও ফিরে চাইনি আমাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্য শতভাগ মূল্য সংযুক্ত পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি সম্ভাবনা বিকাশে। পাটের বাজার ফিরে পেলে আমরা ষোলআনা পোশাক রফতানি-নির্ভর না হয়েও পারতাম। অথচ পাট আবাদ হয় বাংলাদেশে, আর বিশ্বের পাট ও পাটজাত পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায় করে ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম। তা ছাড়া তৈরী পোশাক রফতানি বাজার-বৈচিত্র্য সাধনেও আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করিনি। আমেরিকা, জার্মানি ও ফ্রান্সের বাজার নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছি। অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, জাপান এমনকি খোদ চীনেও যে আমাদের তৈরী পোশাকের ভালো বাজার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেই দিকেও ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আর সব ক্ষেত্রের মতো গার্মেন্ট খাতেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে চলেছে; পৃষ্ঠপোষক, অনুধ্যায়ী, আমলাতান্ত্রিক স্বভাব খাসলত এগুলো তাদের মজ্জাগত। তারা ঘন ঘন বিদেশ সফর করেন বটে, তবে সেই সব দেশ থেকে কিছু শিখে আসেন বলে মনে হয় না।

আমাদের ক্রমাবনতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ শঙ্কা দূর করতে হলে বাণিজ্য ঘাটতি (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) দূর করতে হবে এবং তার প্রধান দুই উৎস হলো তৈরী পোশাক রফতানি ও প্রবাসীদের উপার্জিত রেমিট্যান্স। শঙ্কার প্রধান জায়গাটি হলো দেশের ‘গ্রস রিজার্ভ’ কমতে কমতে ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে (২০২৩-এর জুলাই মাস নাগাদ)। প্রকৃতপক্ষে নিট রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। এই নিট রিজার্ভকে কমপক্ষে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে। অথচ প্রকৃত মজুদ দাঁড়াচ্ছে এর থেকে চার বিলিয়ন ডলার কম।
এ পরিস্থিতিতে রফতানি ও রেমিট্যান্স যেকোনো উপায়ে বাড়াতে হবে। সরকার, সমিতিগুলো এবং তাবৎ ‘স্টেকহোল্ডারদের’ একত্রে চেষ্টা করতে হবে রফতানি গন্তব্য এবং শ্রমবাজারের বহুমাত্রীকরণে। রেমিট্যান্সে কাজ করতে হবে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ- এ মন্ত্রণালয় এবং ‘বায়রার’ সদস্য-উদ্যোক্তাদের; তৈরী পোশাক বাজার বৈচিত্র্যের সন্ধানে কোমর বেঁধে নামতে হবে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ এ খাতের উদ্যোক্তা এবং তাদের প্রধান প্রতিষ্ঠান ‘বিজিএমইএ’ এবং ‘বিকেএমইএ’ ও বিটিএমএকে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও শিল্প চেম্বারগুলোর হতে হবে এই অভিযাত্রার অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি ও সমন্বয়কারী। এখন কোটা নেই বটে; তবে তৈরী পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকের সামনে বড় দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়ান্সের মোকাবেলা করা।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রধান ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো, রিটেইলার চেইন এবং আমদানিকারকদের সমন্বয়ে গঠিত এ দু’টি মোর্চার সন্তুষ্টির ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে আমাদের তৈরী পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকদের পারঙ্গম। ফলে এদের নিরাপত্তা, শ্রম-সংবেদনশীলতা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং একই সাথে দর প্রতিযোগিতা ও সময়ানুবর্তিতায় বেঁধে দেয়া বিধি-বিধানগুলো হুবহু মেনে চলার সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। পোশাক খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগেও বেশ ভাটার টান পড়েছে। করোনার সময় থেকে শুরু হওয়া এই নি¤œমুখিতা আজ পযন্ত কাটেনি। (রেমিট্যান্সের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য)। কখনো অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়ান্সের বিধিনিষেধের যৌথ বাধ্যবাধকতা তৈরী পোশাক উদ্যোক্তাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, উরুগুয়ে-এরাও তো একই নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে টিকে থাকছে। তারা পারলে আমার পারব না কেন? এমএফএ পরবর্তীকালে পোশাকের ধরন বৈচিত্র্যে আমরা বেশিদূর এগোতে পারিনি। পোশাকের বাজার বহুমাত্রীকরণের প্রচেষ্টাও সাধুবাদ দেয়ার মতো নয়। পোশাক তৈরী ও ফ্যাশন বিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়া ‘রিসার্চ’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট উদ্যোগও নিষ্প্রভ। বিশেষ করে বয়ন বস্ত্রে (ওভেন) ও মানুষের তৈরি কৃত্রিম আঁশের সুতা থেকে তৈরী বস্ত্রে বিশ্বজোড়া চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে জাপান, কোরিয়া এসব দেশে। কই, সেদিকে অগ্রগতি খুব একটা চোখে পড়ে কি? পোশাক শ্রমিকদের নৈপুণ্য, দক্ষতা এবং কারখানার পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখনো অনেকটাই বাকি। দিন দিন প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে। অথচ মানবিক নৈপুণ্যের সাথে প্রযুক্তি জ্ঞানের সমন্বয় এবং সৃজনশীল উদ্ভাবনীর বৈশ্বিক অগ্রগতির সাথে আমরা এখনো পুরোপুরি তাল মেলাতে পারছি না। পারছি না উৎপাদনশীলতার ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করতে।

এ জন্য বলছিলাম পোশাক রফতানিতে অর্জনের ধারাকে বহমান রাখতে আমাদের প্রয়োজন বহুপক্ষীয় ও বহুমাত্রিক উদ্যোগ এবং একটির সাথে অন্যটির সুরসঙ্গতি বা সমন্বয়। সরকারের উচিত রোড-রেইল সংযুক্ত বন্দর আরো বাড়ানো এবং পোশাকের কনটেইনার জটলার অবসানকল্পে সড়ক ও রেল অবকাঠামোর আরো সংস্কার। গ্যাস, বিদ্যুৎ এমনিতে ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য ইউটিলিটিজের প্রবাহ ঘাটতি এবং সেবা মানে অবনতি। তাহলে রফতানিকে রেশমের মতো মসৃণ করে তোলার পরিকল্পনার ‘পরী’ উড়ে গিয়ে স্র্রেফ ‘কল্পনাই’ পড়ে থাকবে জমিনে। আর আমাদের হাপিত্যেশ করে যেতে হবে ও ক্রমাগতভাবে বাজার হারাতে হবে। আমরা বিশেষ অঞ্চল বা রফতানি প্রক্রিয়া অঞ্চল কেবল বাড়িয়ে যাচ্ছি। এগুলো কতকটা স্টান্ট বা চাপাবাজি। এসব অঞ্চলে ইউটিলিটিজ সরবরাহ উন্নত এবং গোটা উৎপাদনের কাঠামোগত রূপান্তর ঘটাতে না পারলে খালি জমি দিয়ে বিনিয়োগকারীরা কী করবেন? আমাদের উৎপাদন খরচ এবং মান যদি প্রতিযোগিতাপূর্ণ না করা যায়; তাহলে বিদ্যমান বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে? নতুন নতুন বাজার তালাশের কার্যক্রমও নিষ্ফল হয়ে যাবে। বিষয়গুলো সর্বোচ্চ সরকারি নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনা ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সদিচ্ছার দাবি রাখে।