- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ২০ আগস্ট ২০২২, ২০:০০
‘দেশ যাবে কোন পথে; ফয়সালা হবে রাজপথে।’ এটি একটি স্লোগান। এই স্লোগানে গণতান্ত্রিক অবয়ব আছে। কারণ রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান রাজনৈতিক উপায়েই করতে হয়। রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন মতকে দমন করে রাখা যায়; কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হয় না। এই স্লোগানটির ব্যাখ্যা দাঁড় করার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতাটি সামনে আনতে হবে। আব্রাহাম লিংকন গোটিসবার্গে আড়াই মিনিটের যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটিই গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ সংজ্ঞা হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। তিনি বলেছিলেন, This nation under God shall have a new birth of freedom and that government of the people by the people for the people shall not perish from the earth.
এই বক্তৃতায় তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য, শাসক নির্বাচন এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জনগণের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যে সিদ্ধান্ত নিবেন তা জনগণের জন্যই নিবেন। আর এটাই গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ। রাষ্ট্রীয় শাসকবর্গ যদি কোনো কারণে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তাহলে তারা কখনোই জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে না বরং তারা জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন। নিজেদের আখের গোছানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের দখলে রাখার জন্য দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করেন।
এই দেশের ইতিহাস বহু পুরনো। শাসন করেছেন বহু জাতি গোষ্ঠীর শাসকবৃন্দ। বিদেশী প্রভুত্ব বহু বছর এই দেশের জমিনকে তাদের কলোনিতে পরিণত করেছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ২০০ বছরের জন্য ইংরেজ শাসনের কবলে পতিত হয়েছিল ভারত উপমহাদেশ অর্থাৎ আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভূখণ্ড। ব্রিটিশদের কলোনিমুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে ভারত উপমহাদেশে জন্ম হয়েছে বহু ইতিহাসের। বহু আলোচনা, বহু চুক্তি হয়েছে; সবই ছিল ব্রিটিশরা কিভাবে শাসন করবে তার কৌশলমাত্র কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ফয়সালা রাজপথ থেকেই এসেছে। অবশ্য ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস এবং ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতবর্ষের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। পরে ব্রিটিশ ভারতে যত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সব দলেরই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ কলোনিমুক্ত করা। আর এই দলগুলোর সাথে কোনো না কোনোভাবে ভারতের সর্বস্তরের মানুষের মিলিত আন্দোলনের ফলে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ এখানেও রাজপথই ছিল ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার প্রধান উপায়।
পাকিস্তানের গর্ভ থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনেও রাজপথের ভূমিকাই ছিল বেশি। রাজপথকে উত্তাল করার কারণেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর খায়েশ পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির বাহন ভাষাকে ধ্বংস করতে গিয়ে তা করতে পারেনি। কারণ এই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্য ভাষাকে গ্রহণ করতে চায়নি, যার কারণে তারা নিজেদের রক্ত রাজপথে বিলিয়ে দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে। মূলত ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বহু আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক আয়ুব খানের মসনদকে উৎখাত জনতা করতে সক্ষম হয়েছিল। পরে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে হস্তান্তর করেনি। বহু বৈঠক, সমাবেশ করেও তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে একটি সর্বজনীন যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু যুদ্ধ সফল হয়েছে। অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত আমাদেরকে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে এবং যেসব ইস্যু নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হচ্ছে তা আলোচনার টেবিলে সমাধান হয়েছে। তার উদাহরণ নেই বললেই চলে। জনগণকে রাজপথ থেকেই তাদের দাবিকে আদায় করতে হচ্ছে।
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের যে স্পিরিট ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তা শেষ করে দিয়েছে নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী। তারা গণতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রকে নিয়ে গিয়েছিল। হত্যা, গুম, নিপীড়ন, নির্যাতন, দুর্নীতির নরক রাজ্যে পরিণত করেছিল রাষ্ট্রকে। সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। যারা দেশে স্বাধীনের হোতা বলে দাবি করছে তাদের হাতেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অনিরাপদ ছিল এবং মানুষের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আজো তারা একই কর্মকাণ্ড করে চলেছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ রাখা এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার নামেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো মর্মান্তিক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য ছিল না। এর পরেও রাষ্ট্র হোঁচট খেয়েছে বার বার। স্বৈরশাসক এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনতে অনেক আন্দোলন করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে বহুজনকে। রাজপথের আন্দোলনের কারণেই এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৯১ সালে জনগণ গণতান্ত্রিক উপায়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। জনগণ রাজপথে ছিল বলেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ টানা ২৬৬ দিন হরতাল পালন করেছিল নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আওয়ামী লীগ এবং তার জোটের ডাকা হরতাল এবং বিভিন্ন আন্দোলনের কারণেই বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করেছিল। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়নি বলেই আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ আন্দোলন হরতাল করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করিয়েছিল তারা ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের সুবিধার্থে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে নির্বাচন দিয়ে পরপর দুইবার ইতিহাসের ন্যক্কারজনক নির্বাচন ‘উপহার’ দিয়েছে। এখন জনগণের ভোটের অধিকারকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপিসহ সারা দেশের মানুষকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত নির্দয়ভাবে নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী কায়দায় সেই আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করছে।
প্রতিবাদীকে দমন করার জন্য সরকার নানা রকম নিপীড়নমূলক আইন তৈরি করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকসহ মুক্তমনা বহু মানুষকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে। হত্যা, গুম, অপহরণ, হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতির মাধ্যমে বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করার চেষ্টা করছে। তাদের এই কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের বাহিনীকে ব্যবহার করছে, যার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই দেশের র্যাব ও পুলিশের সাতজন কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার চরম লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর যৌক্তিক দাবিদাওয়া আদায় এবং সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়াজকে দমন করতে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে র্যাব-পুলিশ বাহিনীকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতির অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়নি। জনগণ যখন সরকারের এই দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাচ্ছে তখনই সরকার তাদের ওপর বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবশ্যই রাজপথে দাঁড়িয়ে সরকারের এই অন্যায় ও অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন করার অধিকার জনগণের রয়েছে।
ব্রিটিশ শাসন থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই উপমহাদেশের জনগণ অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় বাঙালির প্রায় আড়াই হাজার বছরের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। তারা বারবার বিজয়ী হয়েছে; কিন্তু দীর্ঘ সময় নির্যাতিত হতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে, ইজ্জত সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে কত মানুষের তার ইয়ত্তা নেই। আর এসব কিছুর বিনিময়ে আমরা রাষ্ট্রের ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি; কিন্তু নাগরিক স্বাধীনতা জনগণ এখনো পায়নি। আর নাগরিক স্বাধীনতা আদায়ের জন্য রাজপথই উত্তম পন্থা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষা দিয়ে আজকের লেখার যবনিকা টানতে চাই। তিনি নবযুগ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘মারো অত্যাচারীকে। ওড়াও স্বাধীনতা বিরোধীর শির। ভাঙো দাসত্বের নিগঢ়। এ বিশ্বে সবাই স্বাধীন। মুক্ত আকাশের এই মুক্ত মাঠে দাঁড়াইয়া কে তাহার অধীনতা অস্বীকার করিবে; এই খোদার উপর খোদকারী শক্তিকে দলিত কর।’