- ড. আবদুল লতিফ মাসুম ০৯ এপ্রিল ২০২০
গোটা বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারী ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই শত শত মৃত্যুর খবর আসছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। মোট শনাক্তের সংখ্যা ১৩ লাখ অতিক্রম করেছে। সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে প্রায় তিন লাখ মানুষ। চীনে প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব ঘটলেও তারা পরিস্থিতি দৃশ্যত সামাল দিতে পেরেছেন। কিন্তু বেসামাল অবস্থা পাশ্চাত্য বিশে^। ‘পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রটি সবচেয়ে অসহায় প্রমাণিত হয়েছে। এই যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যুর হার ২.৯ শতাংশ। একসময়ের প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশ পরাশক্তির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। বোঝা যাচ্ছে, শক্তির মদমত্ততায় আল্লাহ তায়ালার গজবকে মোকাবেলা করা যায় না। জ্ঞানী ব্যক্তিরা একে বলছেন, প্রকৃতির প্রতিশোধ। আর ধর্মবেত্তারা বলছেন, মানুষ বিধাতার সাথে ভারসাম্যহীন আচরণ করায় এ অবস্থা। তারা ব্যাখ্যা করছেন, পাপে-তাপে বিশ^ যখন সীমা লঙ্ঘন করে তখন বিধাতা প্রতিশোধ নেন।’
ম্যালথাস বলে একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তার একটি ‘জনসংখ্যা তত্ত্ব’ আছে। তাহলো, মানুষ অত্যধিক বেড়ে গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে প্রকৃতি ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা হয়। এভাবে ঝড়, বন্যা, প্লাবন এবং মহামারীতে মারা যায় মানুষ। ফলে পৃথিবী অধিক জনসংখ্যার ভার থেকে মুক্ত হয়। কারণ যা হোক না কেন, মহামারী পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বাস্তবতা। ইতিহাসবিদরা বলছেন, প্রতি ১০০ বছরে একবার এ ধরনের মহামারী প্রকোপ দেখা দেয়। পৃথিবীর কোনো অঞ্চলই এ থেকে রক্ষা পায়নি। ইউরোপে প্লেগ মহামারীর ইতিহাস রয়েছে। পৃথিবীর এই অঞ্চলে একসময়ে কলেরা, বসন্ত ও যক্ষ্মার মহামারীর প্রকোপ ছিল। মানুষ তা মোকাবেলা করেছে। কিন্তু বর্তমানে নতুন নতুন ভাইরাস, নতুন নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু কাল আগে পাশ্চাত্যে এইডস দেখা দিয়েছিল। এই তো সে দিন আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে লাখো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সোয়াইন ফ্লু ও নিপাহ ভাইরাস অনেক জীবন কেড়ে নিয়েছে। আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করার জন্য এসব গায়েবি গজব নাজিল করে থাকে।
বাংলাদেশও এটা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেক কিছু থেকে নিরাপদ থাকলেও এবার করোনাভাইরাস স্পর্শ করেছে দেশটিকে। এখানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮ মার্চ। এক মাসের মধ্যে রোগীর সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এখনও খুব বেশি নয়। দেশের মানুষ মনে করে, প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। শুরু থেকে শনাক্তের পরীক্ষা ছিল সীমিত পরিসরে। গত কয়েক দিনে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পরীক্ষার সংখ্যা ও পরিধি বাড়ানো হয়েছে। তখন থেকে রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, শনাক্তকরণের সুযোগ বৃদ্ধি করা হলে রোগীর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। তবে কিঞ্চিৎ স্বস্তির কথা, দেশের দু-চারটি অঞ্চল ছাড়া রোগের বিস্তার সর্বাত্মক হয়নি। অস্বস্তির বিষয়, এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব খোদ রাজধানীতেই বেশি। রাজধানীকেন্দ্রিক রোগের বিস্তারের কারণ হিসেবে বিদেশী এবং বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের নিয়ন্ত্রণ ও শনাক্তকরণে ব্যর্থতা প্রধানত দায়ী। জনগণের অভিযোগ, চীনে এ রোগ সংক্রমণের পর পর যারা দেশের বিমানবন্দরগুলো তথা বহির্গমন বন্দরগুলো দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের যথাযথ পরীক্ষা হয়নি। এমন অভিযোগও রয়েছে যে, ঘুষ দিয়ে তারা প্রবেশাধিকার পেয়েছে। এভাবে অগণিত লোককে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। এই কাজটি করার জন্য সরকারের তরফ থেকে যে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তারা তা নিতে ব্যর্থ। ওই সময়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বজ্র আঁটুনি দেখিয়েছেন বটে, তবে তা ফসকে গেছে। আর যখন তাদেরই ব্যর্থতার কারণে প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন কঠোরতা আরোপ করছেন। ইতোমধ্যে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় সর্বনাশের উদাহরণ হলো- গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খোলা না খোলা নিয়ে। সরকার যখন প্রথম শাটডাউন ঘোষণা করে, তখন গার্মেন্ট শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও অন্যরা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। সরকারের বোঝা উচিত ছিল, বাংলাদেশ আসলে একটা বৃহৎ গ্রাম। নগর সংস্কৃতি এখনো এ দেশে জেঁকে বসেনি। পরে যখন সরকার গার্মেন্টস খোলার অনুমতি দেয়, তখন গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক লোক রাজধানীতে ফিরে এসেছে। এরকম পরিকল্পনাহীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া সরকারের তুঘলকি চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে। এতে বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার প্রমাণ মিলেছে। শ্রমিকদের এভাবে যাওয়া-আসা তাদের জন্য অনেক কষ্টের কারণ। এই মেলামেশা করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো বাড়িয়ে দিয়েছে। একদিকে সরকার পরিবহন বন্ধের কথা বলেছে, দু’দিন পরে পরিবহনকে সীমিতভাবে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীকে দেশের সমগ্র অঞ্চল থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ঢাকা জরুরি প্রয়োজনেও কেউ আসতে পারছে না।
প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণের। সরকারের শিথিলতার কারণে রাজধানীর দোকানপাট সীমিতভাবে খোলা ছিল। এখন তারা ফার্মেসি ছাড়া অন্য কোনো দোকান খোলা রাখতে দিচ্ছেন না। এমন কি মুদি দোকান ও খাবার হোটেলও বন্ধ। অন্য দিকে, রাজধানী বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে খাদ্যশস্য ও শাকসবজি আসছে না। তাই খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। একজন নাগরিক দুঃখের সাথে বলেছেন, এখন হয়তো না খেয়েই মরতে হবে। সারা দেশে খাদ্যসামগ্রী পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়া আত্মঘাতী কাজ। আর দোকানপাট খোলা রাখার ব্যাপারেও একটি নির্দিষ্ট সময়সূচির প্রয়োজন। জনসাধারণের চলাচলের সুযোগ থাকা দরকার। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ বাড়াবাড়ি করছে। সামরিক বাহিনীকে যখন নিয়োগ করা হয়েছে, পুরো দায়িত্বটি তাদের দিলে ভালো হয়। সরকার যথার্থভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারছে বলে মানুষ মনে করে না। এই যে, তিন তিনবার করে শাটডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হলো- তা সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার প্রমাণ। এটা নাগরিক সাধারণের পরিকল্পনা গ্রহণ, যাতায়াত ও কাজকর্মে সমন্বয়ের অভাব ঘটিয়েছে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও বলছে, করোনাভাইরাস বিস্তাররোধে দেশগুলোকে পদক্ষেপ নিতে হবে নিজ নিজ পরিস্থিতি বিবেচনায়। কারণ প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একই পদক্ষেপ সবার বেলায় কাজ করবে না। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারকে দেশের জনসাধারণের স্বভাব-চরিত্র, গতি-প্রকৃতি ও মনস্তাত্ত্বিক গড়ন বুঝতে হবে। বাংলাদেশের লোকেরা একটু হালকা মেজাজের। তারা কঠিনকে সহজে ভালোবাসতে পারে না। তৃণমূলে ফিরে যেতে পছন্দ করে। সহজেই বেড়িয়ে পড়ে ঘুরতে অথবা মজা দেখতে। একে অপরের জন্য সাহায্য ও সহানুভূতি তাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে এটাও মনে রাখতে হবে, তাদের বেশির ভাগ নি¤œ আয়ের ও গরিব। সুতরাং তাদের জন্য এমন সব ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা প্রদান করতে হবে যাতে এসব মানুষ সুরক্ষা পায় এবং সেই সাথে জীবিকার উপায় করে নিতে পারে। সরকার তাদের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা ও সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু তা অপরিকল্পিতভাবে ও তাৎক্ষণিক বিবেচনায়। একজন কর্মকর্তা অপেক্ষমাণ মানুষের মধ্যে টাকা ছড়িয়ে দিলেন অথবা এক দিনের খাবার পৌঁছে দিলেনÑ এটা কোনো সঠিক ব্যবস্থা হতে পারে না।
গ্রাম থেকে শহর ও রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে সরকারের নেটওয়ার্ক। তারা যথার্থ ত্রাণপ্রার্থীদের তালিকা তৈরি করতে পারেন। সমস্যা হলো- এই সরকারের বদনাম রয়েছে দুর্নীতি ও দলীয়করণের দরুন। তাই বিরোধী দলের অভিযোগ ত্রাণবণ্টন নিয়ে। এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সর্বদলীয় ত্রাণ কমিটি বা পেশাভিত্তিক কমিটি করা যেতে পারে। বেসরকারি খাতগুলো সহযোগিতা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বড় বড় ব্যবসা, শিল্প ও সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে। তাদের সহযোগিতার সদ্বব্যহার দরকার। সরকার আজো বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহার করেনি। অথচ দেশের সর্বাধিক মানুষ বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল। অনেকে মনে করেন, তথ্য ও পরিসংখ্যনের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য সরকার তাদের কাজে লাগায়নি। এখন অবস্থা যখন ক্রমেই অবনতির দিকে, সরকারের উচিত এই সঙ্কটময় মুহূর্তে তাদের সেবা গ্রহণ করা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। দেশে এই ভাইরাস পরীক্ষাকরণের ব্যবস্থাপনার ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়। সুতরাং সরকারের উচিত বেসরকারি হাসপাতালের সক্ষমতাকে কাজে লাগানো। এই অস্বাভাবিক অবস্থায় এতদিন সব বেসরকারি হাসপালের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সরকার তাদের হাসপাতাল চালু রাখার অনুমতি দিয়ে ভালো করেছেন। এখন তাদের সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগী হওয়ার সুযোগ এসেছে।
একটি জরুরি সঙ্কটময় সময়ে যেকোনো সরকারের উচিত সবার প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা। দলমত নির্বিশেষে সবাই সরকারকে সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের সব ধরনের সেবাপ্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এখন উচিত জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায় সমন্বয়। সরকারের উচিত একটি ‘প্রতিরোধ কৌশল’ ঘোষণা করা। নাগরিক সমাজ এখনো পরিষ্কার নয় সরকারের সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম ও পরিকল্পনা সম্পর্কে। আর্থিক প্রণোদনা ও ত্রাণ কার্যক্রমের নানা ঘোষণা আসছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতের সর্বাত্মক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়। আল্লাহ না করুন, মহামারী যদি অন্যান্য দেশের মতো ধেয়ে আসে প্রবল বেগে, তাহলে কিভাবে সরকার তা মোকাবেলা করবে- সে বিষয়ে নির্দেশনা ও পরিকল্পনা অনুপস্থিত। আশঙ্কার বিষয় এই যে, অন্যান্য আপৎকালীন সময়ে বিদেশের সহযোগিতা পাওয়া যেত, এখন যেহেতু তারা আমাদের চেয়েও বেশি বিপদগ্রস্ত, সেহেতু আমাদের দাঁড়াতে হবে নিজের পায়েই। আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে আমাদের এই সঙ্কটময় সময় অতিক্রম করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়