দেশে কি দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছে

  • এইচ এম আবদুর রহিম
  •  ১৫ এপ্রিল ২০২২, ২০:৩৯, আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২, ২০:৫৮

– ছবি : নয়া দিগন্ত

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া এখন দেশবাসীর কাঁধে জেঁকে সওয়ার হয়েছে। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দামে আগুন। চাল, ডাল, মাছ, গোশত, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি সব কিছুরই দাম আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজার ব্যবস্থার ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না।

এই নিয়ন্ত্রণহীনতা দেখা গেছে ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীদের চাপে দেশে একাধিকবার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়। এরপরও বাজারে এখন সয়াবিন তেল নেই। তেলের মজুতদারি রোধে খোলা তেল বিক্রির ওপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। এ দিকে সয়াবিন তেলের ৬০ শতাংশই খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। বাড়তি দামের কারণে বোতলজাত সয়াবিন অনেকে কিনতে পারেন না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মতে, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। সে অনুযায়ী এক মাসের চাহিদা এক লাখ ৫০ হাজার টনের মতো। সয়াবিন তেলের পুরো ব্যবসাই হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে। ফলে এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কঠিন নয়। এরপরও সরকার তা করতে পারল না কেন, সেটিই প্রশ্ন।

করোনার ধাক্কায় বিশ্বের অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থা টালমাটাল। তার ওপর যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি। এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ দেশে ধানের ভালো উৎপাদন হয়েছে। মজুদও যথেষ্ট আছে। ফলে ঘাটতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও যে চাল কিনতে সাধারণ মানুষকে কেন হিমশিম খেতে হচ্ছে তার কারণ মানুষের আয়রোজগার কমে গেছে। পাশাপাশি বাজারে সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একেক সময় বাজার থেকে একেক পণ্য উধাও হয়ে যায়। কখনো লবণ, কখনো চিনি, কখনো পেঁয়াজ। যেন পালা করে এককে পণ্যের ব্যবসায়ীরা ‘সমঝোতা’ করে নেন বা তাদের সুযোগ করে দেয়া হয়। একেক পণ্যের নামে লুট হয়ে যায় জনগণের পকেট, খালি হয়ে যায় মধ্যবিত্তের সঞ্চয়। এখানে পাইকার থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাজার ম্যানিপুলেট করেন। এখন ধমক দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ধমকে কিছু কাজ হলেও সেটি নিতান্ত সাময়িক। এখানে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, চাহিদা মেটাতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এবং অপরাধীদের শাস্তি না দেয়ার কারণেই বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, মজুদদারি, পণ্যে ভেজাল দেয়া, এগুলো ঘটে থাকে।

মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে বাজারে মোবাইল কোর্ট দেখা যায়। দু-চারজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। সেটিও নিয়মিত নয়, কার্যকরও নয়। কারণ অপরাধের দায়ে কারো লাইসেন্স বাতিল বা দোকান সিলগালা করার ঘটনা সাধারণত ঘটে না। ব্যবসায়ীরা জরিমানার অর্থ পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কেটে আদায় করে নেন।

২০২০ সালের ফেব্রæয়ারির তুলনায় চলতি ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারিতে জিনিসপত্রের দাম শতকরা কতভাগ বেড়েছে তার একটি হিসাব দিয়েছে টিসিবি। তাতে দেখা যায়, মোটা চালের দাম ৩২ শতাংশ, সরু চাল ২৮, বোতলজাত সয়াবিন ৫৫, খোলা সয়াবিন ৮২, মোটা দানার চিনি ৩২, ব্রয়লার মুরগি ২১, খোলা আটা ২২ ও এলপি গ্যাসের দাম ১৮ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ এখনো একটি গরিব দেশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনসাধারণের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। বাজারে যেন সত্যিই আগুন জ্বলছে। পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, চালসহ সবধরনের সবজি ও মসলার দাম বেড়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়তি দাম। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত -নিম্নবিত্ত সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ না পারছে এত দাম দিয়ে জিনিস কিনতে, না পারছে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে থাকতে। সবচেয়ে বেশি ভুগছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর, যারা প্রতিদিনের খাবার কিনে খান। জিনিসের দামের সাথে শ্রমের মূল্য বাড়েনি।

এ কারণেই এখন টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। টিসিবির ট্রাকের আশায় মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছে, কেউ পণ্য কিনতে পারছে, কেউ পারছে না। মানুষ ট্রাকের পেছনে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে, চলন্ত ট্রাকের ওপর হামলে পড়ছে। দেশে যেন দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে।

পরিতাপের বিষয় হলো, এই অস্থিতিশীল অবস্থা নিরসনে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য-সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ ও যন্ত্রণাদায়ক। পবিত্র রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবহার্য সব পণ্য এবং পবিত্র বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে পণ্যবাজারে বিশাল মূল্যহ্রাস প্রথা চালু আছে; কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি উল্টো। রমজান, ঈদ, পূজা এলেই আমাদের দেশের সব ব্যবসায়ী সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মেতে ওঠেন। ফলে রমজান এখন দেশবাসীর জন্য আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলাম ধর্মে অতিরিক্ত মূল্য আদায় কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য আদায় করে এ সুযোগে যে, ক্রেতা পণ্যের মূল্য জানে না; তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ পর্যায়ের গণ্য হবে।’ আবার মজুদদারি সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মজুদ করে সে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর দাম বেড়ে গেলে আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত)

কিন্তু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা রমজানের আগেই পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজান মাসে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নানা রকম অঙ্গীকার থাকে; কিন্তু বরাবর দেখা গেছে, কোনো বিশেষ উপলক্ষে বাজারের নাটাই থাকে অশুভ চক্রের হাতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের অঙ্গীকার এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে কঠোর হুঁশিয়ারি সত্তে¡ও কার্যত কিছুই হয় না। সে জন্যই বাজারে অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিছু মধ্যস্বত্বভোগী, আগাছা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটেছে। আর ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাথে ভোক্তা সংগঠনগুলোর ব্যবধান এত বেশি হয়ে গেছে এবং তাদের ক্ষমতা এত বেশি যে, তাদের হাতে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, সরকারি প্রশাসনযন্ত্রও অসহায় হয়ে পড়েছে। সে কারণে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সব মহল ব্যবসায়ীদের বারবার অনুরোধ করার পরও তাদের সেই প্রতিশ্রæতি কাজে আসে না। একইভাবে যারা আমদানি করছেন, তাদের আমদানি ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের ব্যবধান দেখতে হবে। যেমনÑ ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে এক ডলার বা ৮৫ টাকা বাড়লে বাংলাদেশে সেটি ৩০০ বা ৪০০ টাকা বেড়ে যাওয়া মেনে নেয়া যায় না।

মূলত সরবরাহজনিত সমস্যাই আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আমাদের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয় এবং সরবরাহ চেইন একেবারে দুর্বল। আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে ম্যানিপুলেশন ঠেকাতে না পারা এবং এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না দিতে পারা। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দেশের বাইরে একের পর এক ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠছে। যতই অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের সাফল্যে আমরা বিভোর থাকি না কেন, ৬০ শতাংশের বেশি সংসদ সদস্য যে ব্যবসায়ী সে কথা তো সবারই জানা।

কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে আয়ের তুলনায় কয়েকগুণ। মানুষের সঞ্চিত অর্থে হাত পড়েছে। মূল্য বৃদ্ধির কারণে ১৭ কোটির মধ্যে ১৩ কোটি মানুষকেই অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বাংলাদেশে ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত যেকোনো নীতিনির্ধারণমূলক ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অসম অংশগ্রহণ থাকে নামমাত্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ, মূল্য নির্ধারণ-বিষয়ক যেকোনো সভায় শুধু ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের সরকারি কর্মকর্তারা অংশ নেন। এখানে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নেই। তাই সাধারণ ভোক্তা বা জনগণের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরা হয় না। এখন প্রয়োজন সরকারের একচেটিয়া ব্যবসায়ী তোষণনীতি পরিহার করে ভোক্তাদের সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়ন। হ
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ই-মেইল : rahimkhulna8@gmail.com