- ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০৩
‘সে হয়তো ভুলবশত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে।’ একজন বাংলাদেশী ফুটবলারের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে এই মন্তব্যটি করেছিলেন জাতীয় দলের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। সেই ফুটবলারের নাম মোনেম মুন্না। যিনি এখন শুধুই ইতিহাস, দূর আকাশের তারা হয়ে তার বাস।
মোনেম মুন্নাকে বাদ দিয়ে কখনোই লেখা যাবে না বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাস। আপনি চাইলেও ভুলতে পারবেন না তাকে, নানা গল্প, স্মৃতি আর অর্জন নিয়ে মোনেম মুন্না আপনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যাবে বিলক্ষণ।
বাংলাদেশ ফুটবলের কথা উঠলেই তারা স্মরণ করে মোনেম মুন্নাকে। মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশ নন, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা ফুটবলার। ক্যারিয়ারের মাঝামাঝিতে খেলেছেন কলকাতার ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলের হয়েও। কাঁটা তারের ওপারের মানুষগুলোর কাছেও মুন্নার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী।
সাধারণত ফুটবলে যা দেখা যায়, তা হলো নিচের পজিশনে যারা খেলে তাদের দিকে খুব একটা আলো আসে না। স্ট্রাইকারদের তুলনায় একটু আঁধারেই থাকেন তারা। কিন্তু তার বেলায় মুদ্রার উল্টাপিঠ। ডিফেন্ডিং পজিশনে খেলেও সমস্ত আলো নিজের দিকে কেড়েছেন এক মোনেম মুন্না।
দলের নেতৃত্ব আর দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশ ফুটবলে রীতিমতো ‘নায়ক’ বনে গিয়েছিলেন।
৮০ দশকের শেষ ভাগ আর ৯০ দশক জুড়ে দেশের ফুটবল ছিল মুন্নাময়, এতে কোনো সন্দেহ নেই ফুটবল বোদ্ধাদের। ১৯৯১ সালেই আবাহনী থেকে মুন্না পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ২০ লাখ টাকা। যেটা সেই সময় কেবল বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারের রেকর্ড পারিশ্রমিক নয়, উপমহাদেশেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এই পারিশ্রমিক। এখনকার ফুটবলাররা তার রেকর্ড ভেঙেছেন কিন্তু সেই ২০ লাখের আবেদন এখনো রয়েই গেছে দেশের ফুটবলে।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডার ভাবা হয় রক্ষণ ভাগের এই অতন্দ্র প্রহরীকে। ঢাকার মাঠে মুন্নার অভিষেক হয় ১৯৮১ সালে পাইওনিয়ার লিগে। ওইবার খেলেন গুলশান ক্লাবের হয়ে। এরপর শান্তিনগরের হয়ে খেলেছেন দ্বিতীয় বিভাগ। পরের বছর চুক্তিবদ্ধ হন মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাথে। ওই বছরই চ্যাম্পিয়ন হয় মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮৬ সালে ঘটা করে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান মোনেম মুন্না। আর ১৯৮৭ থেকে ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা ক্লাব ফুটবলে কাটান আকাশী নীল শিবিরে। এর মাঝে ১৯৯১-৯২ সালে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গলের হয়েও মাতিয়ে আসেন পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৯৫ সালের চার জাতীর ফুটবলের শিরোপা আসে মুন্নার হাত ধরেই। যা আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা।
১৯৯৭ সালে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন মুন্না। মাঠ থেকেও অবসর নিলেও সর্বদা ছিলেন ফুটবলের সাথেই। এরপর কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালের আজকের দিনে মৃত্যুর কাছে হার মানেন মুন্না। সেই দিন থেকে আজ, পেরিয়ে গেছে দেড় যুগ; আর মোনেম মুন্নাও এখন শুধুই সোনালী অতীত। এই ১৮ বছরে কত কেউ এলো-গেলো, কিন্তু একজন মোনেম মুন্নার আর দেখা মেলেনি আজো, এখনো।
শেষ করছি মোনেম মুন্নাকে নিয়ে প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবলার ও ইস্টবেঙ্গলে মোনেম মুন্নার সতীর্থ কৃষ্ণেন্দু রায়ের কিছু স্মৃতিচারণ দিয়ে৷
‘সবুজ মাঠে মুন্নার পা দুটি যেন বলত, তার উপস্থিতি আমাদের আশ্বস্ত করত, সাহস জোগাত, নির্ভরতা দিত। আমরা মনে করতাম, মুন্নাভাই আছেন যখন, তখন আর চিন্তা কীসের! মাঝমাঠে যখন দাঁড়াতেন, তখন মনে হতো রাজা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। খেলা শুরু হলে মুন্নাভাই জাদু দেখাতে শুরু করতেন।’
‘অনেকেই বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসা করেন মুন্না ভাইয়ের সেরা ম্যাচ কোনটা? আমি উত্তর দিতে পারিনি। কেননা মুন্নাভাই কোন ম্যাচ খারাপ খেলেছিলেন, সেটাই তো আমি মনে করতে পারি না।’