মাহবুবউল্লাহ: আমরা আসলে একটা অনির্ধারিত গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছি। আমরা এখন অজানা পথের যাত্রী। কোথায় গিয়ে আমরা পৌঁছাব, তার কিছুই জানি না। দারুণ অনিশ্চয়তায় আছে দেশ ও দেশের মানুষ।
মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন কেমন হবে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকার পরও সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া ভোটারদের অংশগ্রহণ কতটা হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কেউ বলছেন ভোটার উপস্থিতি হবে ৫ শতাংশ, কেউ ১০। কেউবা আবার বলছেন ২০ শতাংশের বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সরকার নানা চেষ্টা করছে। সরকারি দলের লোকজন বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বলছেন। ভোটার তাঁর প্রার্থীকে ভোটে জিতিয়ে আনতে কেন্দ্রে যান। কিন্তু এবার মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোটের সঙ্গে নেই। এই নির্বাচন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি, ব্যতিক্রমী নির্বাচন।
আর কোথাও এমন ধরনের নির্বাচনের নজির আছে?
মাহবুবউল্লাহ: আমাদের দেশেই তো আছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে কী ঘটেছে? আমি বলতে চাই, মনের তাগিদ না থাকলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায় না। সেই তাগিদটা দেখা যাচ্ছে না। আসলে রাষ্ট্রের ভিত হলো জনগণের ঐক্য। জনগণের মধ্যে বিরোধ থাকে, মতানৈক্য দেখা দেয়। কিন্তু বৈপরীত্যের মধ্যেও একটা ঐক্য থাকে। জওহরলাল নেহরু যাকে বলেছিলেন ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’। কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, সেটাকে আমি বেদনাদায়ক বলি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। বাবাকে না পেয়ে পুলিশ ছেলেকে ধরছে, বড় ভাইকে না পেয়ে ছোট ভাইকে। এই সব কর্মকাণ্ড চিরতরে সমাজের মধ্যে একটা ভেদরেখা টেনে দিল। এটা জাতির জন্য বড় ক্ষতি। কথাই তো ছিল বিদেশে বাঙালিমাত্রই সজ্জন। সেটাও হারিয়ে গেছে। বিদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় বড় সংগঠন হয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আগের সেই ঐক্য আর নেই।
মাহবুবউল্লাহ: ১৯৭১ সালে যেমন অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল, এই অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব নিশ্চয়ই তেমন হবে না। এমনকি ব্রিটিশ আমলে যে বিলিতি পণ্য প্রত্যাখ্যানের অসহযোগ, তা–ও দেখা যাবে না। শেষ পর্যন্ত এটা হবে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কর্মসূচি। এই মুহূর্তে তাদের যে রাজনৈতিক কাঠামো বা সাংগঠনিক অবস্থা, তার মধ্যেও তারা হয়তো চেষ্টা করে যাবে। হয়তো কর্মী-সমর্থকদের তারা বলতে চাইছে আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। দলটির বহু নেতা–কর্মী কারাগারে। কেন তাঁরা কারাগারে, তা নিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কিন্তু একটা টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপির লোকজন বাইরে থাকলে গাড়িঘোড়া চলত না। তঁাদের এক রাতের মধ্যে বের করে আনাও সম্ভব ছিল, এমন মন্তব্যও করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক অবশ্য ভিন্ন দাবি করেছেন। এটা আসলে আওয়ামী লীগের একটা কৌশলও হতে পারে।
মাহবুবউল্লাহ: তারা বলবে যে আমরা পরিস্থিতি লুকাইনি। আসলে এই গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা হয়েছে। কেউই এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তারা গ্রেপ্তারের যৌক্তিকতা বোঝানোরও চেষ্টা করে থাকতে পারে।
মাহবুবউল্লাহ: এসব ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। ২০১৩ সালে অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়ে কিন্তু অনেক ধরনের আলোচনা আছে। কেউ কেউ বলেছে সরকারি দলের লোকজনই আগুন লাগিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় এবারও সরকারি দলের লোকজন ধরা পড়েছে। একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তাঁর এলাকার একজন আওয়ামী লীগ নেতাই অভিযোগ তুলেছিলেন। রাজনীতি যে আসলে কে কী উদ্দেশ্যে কীভাবে ব্যবহার করেন! আমার নিজের খুব খারাপ লাগে। ট্রেনের বগিগুলো পুড়তে দেখলাম। মানুষ মারা গেল। খুব কষ্ট হয়। এগুলো তো আমার দেশের সম্পদ। কিন্তু আগুনটা লাগাচ্ছে কারা? গুপ্ত হামলা–হত্যাও কোনো ভালো কাজ নয়। আমাদের আমলাতন্ত্র, আমাদের বিচার বিভাগ, পুলিশ, শিক্ষা সবকিছুতেই ব্যর্থতার ছাপ। এগুলো কাম্য নয়, অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ও দেশের জন্য বিরূপ কিছু ঘটছে। পরে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। ঐক্যের জায়গায় ফাটলটা আমাকে সবচেয়ে পীড়া দেয়। এই দেশটার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক সময় হতদরিদ্র কারও বাসায় আমি আত্মগোপন করেছি। তারা কত কষ্ট করেছে, ভাবলে খুব খারাপ লাগে।
মাহবুবউল্লাহ: সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুব আছে বলে মনে হয় না। বারবার একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা টেকসই হয় না। ওই যে বলে না বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান…। এ কথা কি সবাই ভুলে গেছে? মানুষকে তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতেই এসব উক্তি, গান-কবিতার সৃষ্টি। তরুণ–যুবকদের বলব, হতাশা শেষ কথা নয়। বিশ্বের অনেক দেশই ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে গেছে। আমেরিকায় সিভিল ওয়ার হয়েছে, সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে ভুগেছে এই সেদিন পর্যন্ত। যুক্তরাজ্য, ভারতবর্ষ, চীন সবাইকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে মানুষের মধ্যে উপলব্ধি আসে। এই উপলব্ধিটাই মুখ্য। একদিন না একদিন এই উপলব্ধি আসবে যে আমরা যে পথে চলছি, সেই পথটা সঠিক নয়। কবি গোলাম মোস্তফা সুরা ফাতিহার অনুবাদ করেছিলেন। তার একটি অংশ হলো, ‘সরল সঠিক পুণ্য পন্থা/ মোদের দাও গো বলি/ চালাও সে-পথে যে-পথে তোমার/ প্রিয়জন গেছে চলি।’ তো আমরাও এই প্রার্থনা করি যেন সরল, সঠিক ও পুণ্য পন্থা খুঁজে পাই।
প্রথম আলো