- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৭ মে ২০২৩, ২৩:৩২, আপডেট: ২৭ মে ২০২৩, ২৩:৫৫
স্মরণকালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে খারাপ সময়ে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে সিপিডি। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী বেড়ে যাওয়া ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবেও অভিহিত করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ(সিপিডি)।
বেসরকারি এই গবেষণা সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, প্রণোদনার অর্থ পাচার হয়ে রেমিট্যান্স হয়ে ফিরছে কীনা তা আমাদের খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসায় দেশের বাজারে এই তেল লিটার প্রতি ৫ থেকে ১০ ভাগ কমানোর পরামর্শ দিয়েছে এই সংস্থাটি। সাম্প্রতিক মার্কিন ভিসা নীতিকে দেশের জন্য ‘অসন্মানজনক’ হিসেবে অভিহিত করেছে সিপিডি।
শনিবার (২৭ মে) ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২২-২০২৩: তৃতীয় অন্তবর্তীকালীন পর্যালোচনা’ প্রকাশকালে রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্র তুলে ধরে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সেখানেই সন্দেহের বিষয়টি অবতারণা করেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটা একেবারেই আনইউজাল, কখনোই হয় না। কারণ, আমরা জানি আমাদের বেশিরভাগ রেমিট্যান্স কোথা থেকে আসে। গত ১০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৯ দশমিক ২২ লাখ মানুষ গেছে। সেখান থেকে প্রত্যাশা মতো রেমিট্যান্স আসছে না। লোক যাওয়া ও রেমিট্যান্সের মধ্যে মিসম্যাচ হচ্ছে। এতদিন সৌদি আরব থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন সে জায়গা দখল করেছে।
তিনি বলেন, এতদিন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এলেও বর্তমানে সে জায়গা আমেরিকার দখলে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সৌদি থেকে ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিকে সন্দেহের চোখে দেখছে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায় তাদের বেশিভাগই হোয়াইট কালার জব করে। অনেকেই ঘরবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষার্থীও সেদেশে আছে। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারে না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে!
তিনি বলেন, এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমন যেখান থেকে টাকাটা পাচার হয়েছে সেটা আবার রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফেরত আসছে। রেমিট্যান্সের ওপর যে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ বা সাবসিডি দেয়া হচ্ছে সেটার সুযোগ নেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আরো গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক সাময়িকভাবে কমানো হলে তারা স্বস্তি পাবে। সেক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম নিম্নমুখী হলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, দরিদ্রদের প্রত্যক্ষ সহায়তার আওতা বাড়ানো দরকার। সঠিক ব্যক্তিরা সহায়তা পাচ্ছে কি না, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রফতানি বৃদ্ধির হার ইতিবাচক নয়। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হচ্ছে। মে ও জুন মাসে তা ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে। যেটা খুবই কষ্ট সাধ্য।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে
অকটেন, পেট্রল, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি লিটারে এখন ৫ থেকে ১০ টাকার কমানোর সুযোগ বলে মনে করে সিপিডি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনার পর বর্তমানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি লিটার ডিজেলে ৫ টাকা এবং প্রতি লিটার অকটেনে ১৩ টাকা মুনাফা করে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এই ৭ বছরে বিপিসি মোট ৪৩ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। কর দেয়ার পর নিট মুনাফা ৩৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। আর এই সময়ে ৭ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা কর দিয়েছে বিপিসি।
এ বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি খাতে বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এখানে এখন কিছু করা যেতে পারে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ে, তখন দেশের বাজারের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে, তখন স্থানীয় বাজারে দাম কমানো হয় না।
বাংলাদেশে গত আগস্ট মাসে হঠাৎ অকটেন, পেট্রলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৩৩ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। বৃদ্ধির ওই হার ছিল গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়। এ ছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যে বেশি দামে আমদানি করতে হয়েছে।
নতুন মার্কিন ভিসা নীতি দুঃখজনক
বাংলাদেশীদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির শর্ত আরোপ করে ভালো নির্বাচন চাওয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ বাজার হওয়ায় ভিসানীতির বিষয়ে সরকারকে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তারা (আমেরিকা) ভিসানীতির বিষয়টিকে বাংলাদেশের সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ও ভালো নির্বাচনের সাথে সংযুক্ত করেছে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, এটি আমাদের জন্য খুবই অপমানজনক। আমাদের নিজেদের জন্যই সুষ্ঠু নির্বাচন করা উচিত।
সিপিডি ফেলো আরো বলেন, শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ভালো নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া, জাতি ও নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। এ অনুধাবন সবাইকে ও সব রাজনৈতিক পক্ষেরই থাকবে বলে আশা করি। কারণ, রাজনীতিকরা গোষ্ঠীগতভাবে আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেন।
তিনি বলেন, আমেরিকাই একমাত্র বাজার যেখানে শুল্ক দিয়েও প্রতিযোগিতায় সক্ষম বাংলাদেশ। ২০২৬ বা ২০২৯ সালের পর ইউরোপ, কানাডা বা ভারতের বাজারে শূন্য শুল্কের সুবিধা থাকছে না। কিন্তু মার্কিন বাজারে শুল্ক দিয়ে ঢুকেও প্রতিযোগিতায় টেকা যায়। এ বাজার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য ভিসানীতির বিষয়টি সাবধানতার সাথে বিবেচনা করতে হবে।