‘দেশের অনেক ব্যাংকের পরিস্থিতিই এখন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মতো’

 

bonikbarta.net

বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৫ সালের ১ মে থেকে ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তিনি। অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশের সব মহলে তার সুপরিচিতি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা, গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা, ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাছান আদনান

দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

একেবারে মোটা দাগে বলতে গেলে ব্যাংক খাত এখন যে অবস্থানে আছে, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। অল্প কিছু ব্যাংকে আগেও সমস্যা ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মৌলিক সমস্যা ছিল খেলাপি ঋণ। তবে দেশের অর্থনীতিতে এ ব্যাংকগুলোর অবদানও যথেষ্ট ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবদান ছিল ইতিবাচক। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) দেশের কৃষকদের জন্য কাজ করেছে। আশির দশকের শুরুর দিকে প্রথম প্রজন্মের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও সংকটে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ওই ব্যাংকগুলো নিজেদের সংস্কার করেছে। খারাপ সময় কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু ব্যাংক খাতের এতটা খারাপ অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। এখন বেশির ভাগ ব্যাংকেই সুশাসনের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে।

২০০৫ সাল-পরবর্তী চার বছর আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম। সে সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০-১১ হাজার কোটি টাকা। এখন খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ থেকে তেমন কোনো আয় নেই। এসব ঋণ আদায় হবে সে সম্ভাবনাও খুব কম। গভর্নর থাকা অবস্থায় আমি ব্যাংকগুলোকে রীতিনীতি মেনে চলতে বাধ্য করেছি। সে সময় সিআরআর, এসএলআর ঘাটতি হওয়ার মতো ঘটনা শুনতে হয়নি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ নীতিতে কোনো ছাড় দেয়া হতো না। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল নীতিও ছিল বেশ শক্ত। নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো শিথিলতা দেখানো হতো না। কিন্তু এখন ব্যাংকিং রীতিনীতি মেনে চলার কোনো বালাই নেই। ব্যাংক পরিচালকদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিচারে আইন প্রয়োগে হেরফের হচ্ছে। কোনো অর্থ পরিশোধ না করেও প্রভাবশালীরা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নিচ্ছেন। আইন ও ব্যাংকিং রীতিনীতির ব্যত্যয় আগে দেখিনি।

গভর্নর থাকা অবস্থায় ব্যাংক খাত পরিচালনায় রাজনৈতিক চাপ কেমন পেতেন?

এর আগে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পলিটিক্যালি এত মোটিভেটেড ছিল না। রাজনীতিবিদরা ধরেই নিয়েছিলেন ব্যাংক খাত পেশাদারত্ব বজায় রেখে চলবে। ব্যাংক পরিচালনায় রাজনীতিবিদদের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। সে সময় যারা সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হতেন, তাদের অনেকের হয়তো পলিটিক্যাল লিংক ছিল, কিন্তু সেটা এক্সপ্লোর করতেন না।

আমার সময়ে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে কোনো ব্যাংকে ঝামেলা হয়নি। সে সময়ে কোনো ব্যাংক সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হলে তা কঠোর দৃষ্টিতে দেখা হতো। আমার মনে আছে, সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মাঝেমধ্যে সিআরআর, এসএলআর রাখতে পারত না। আমরা সরাসরি বলতাম সিআরআর, এসএলআর না রাখলে জরিমানা দিতে হবে। জরিমানা পরিশোধে বাধ্য করা হতো। কোনো ব্যাংকের মূলধন কিংবা প্রভিশন ঘাটতি থাকলে এজিএমের অনুমোদন দিতাম না। মনে পড়ছে, একটি ব্যাংকের এমডি কান্নাকাটি করে মাফ চাইলে তাকে বলা হয়েছিল, এত দিনের মধ্যে ঠিক করো। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটি শর্ত পূরণ করেছে। কঠোর হস্তে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করা হতো। ব্যাংকিংয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিতা ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ ছাড় ছিল না।

কিন্তু ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে আমরা ভিন্ন নীতি দেখেছি। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক লোক নিয়োগ দেয়া হলো। পর্ষদে বসে তারা রাজনৈতিক কথাবার্তাই বলতেন। এর ফলাফল হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বেসিক ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে সফল একটি ব্যাংককে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা রাজনীতিকরণ দেখেছি। ফলাফল প্রতিটি ব্যাংক দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিরাও এখন রাজনৈতিক রঙ ধারণ করছেন। এটির ফলও ভালো হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

তাহলে কি আমরা বলব, বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বায়ত্তশাসন হারিয়েছে?

অবশ্যই। যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে প্রচুর ক্ষমতা থাকে, স্বায়ত্তশাসন থাকে। অনেক দেশের সরকারই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে চায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিজেদের স্বায়ত্তশাসন ধরে রেখে রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজের ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসনকে কীভাবে ব্যবহার করছে সেটির প্রতি জনগণের নজর থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখে। কোনো ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থার তখনই চিড় ধরে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল হয়ে যায়।

আমি যখন গভর্নর ছিলাম, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো নতুন ব্যাংক দেন। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যুক্তি আমি শুনেছি। কিন্তু অর্থনীতিতে প্রয়োজন না থাকায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিইনি। ওই সময় পরপর দুটি ব্যাংকের এমডিকে স্যাক করেছিলাম। তারা অনেক দেনদরবার করেছিলেন, কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আদালতেও গেলেন। কিন্তু মামলায় হেরেছেন। একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে আমি সরিয়ে দিয়েছিলাম। টেকনিক্যাল রিজনে সে একটা ব্যাংকে খেলাপি ছিল। তাকে বলা হলো চেয়ারম্যান থাকতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। আইন ও বিধিবিধানের অনুসরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ছাড় দেয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

পদ্মা ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে, সেটি কোনো ব্যাংকিং নর্মসের মধ্যে পড়ে না। ব্যাংকটিকে সিআরআর, এসএলআর রাখার ক্ষেত্রেও ছাড় দেয়া হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ আনার কথা বলে আর্থিক প্রতিবেদনে নয়ছয় করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এগুলো ব্যাংকিং এথিকসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কবে থেকে, কেন এবং কীভাবে নতিস্বীকার শুরু করল?

২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে আমরা ভিন্ন এক বাংলাদেশ ব্যাংক দেখলাম। ড. আতিউর রহমান গভর্নর হয়ে বললেন, ‘ডেভেলপমেন্টাল সেন্ট্রাল ব্যাংক বা উন্নয়নমূলক কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’ নতুন এ তত্ত্ব জনগণের মাঝে ব্যাপক প্রচার শুরু হলো। আমরা দেখলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় বড় বিলবোর্ড টাঙাচ্ছে। দেশের নানা প্রান্তে সভা-সমাবেশ করছে। গভর্নরের পক্ষ থেকে উন্নয়নের নানা গল্প শুনতে থাকলাম। কিন্তু এটিও তো মনে রাখা দরকার ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ঋণ দেয় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো মুদ্রানীতির প্রণয়ন, সেটির বাস্তবায়ন ঘটিয়ে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ। ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে ঋণ বিতরণের যথাযথ নজরদারি ও খেলাপি ঋণ কমানো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকঋণের সুফল পৌঁছানোও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা দেখলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল কাজ থেকে দূরে সরে গেল। ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব চালু নিয়ে দেশে হইচই পড়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী লাভ হলো? ব্যাংকগুলোয় কোটি কোটি হিসাব তৈরি হলো, কিন্তু সেগুলোয় কোনো লেনদেন নেই। নিম্ন আয়ের মানুষরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে চলে গেছে। মাঝখান দিয়ে উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়ে গেল। সস্তা স্লোগান দিয়ে যে কোনো লাভ হয় না, সেটিই প্রমাণিত হলো।

নতুন ব্যাংক প্রসঙ্গে বলছিলেন, আপনার ওপরও চাপ ছিল। সে সময়ে আপনি কীভাবে ম্যানেজ করতেন? পরবর্তী সময়ে যারা দায়িত্বে এসেছেন, তারা কেন সে চাপ নিতে পারেননি?

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পলিটিক্যাল হয়ে গেছে। সরকার থেকে নতুন ব্যাংক দেয়ার জন্য নির্দেশনা এসেছিল। আমরা বললাম, ‘নতুন ব্যাংক দিতে হলে কতগুলো ক্রাইটেরিয়া মানতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে নতুন ব্যাংক লাগবে কিনা? আগে সমীক্ষা যাচাই করি। তারপর দেখা যাবে।’ অনেকে নতুন ব্যাংক পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মাঝেমধ্যে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা হতো, নতুন ব্যাংক কতদূর? আমরা বলতাম, দেখছি। শেষ পর্যন্ত সরকারকে আমরা বললাম, আমাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তাতে নতুন কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। যে ব্যাংকগুলো আছে, সেগুলো ভালো করতে হবে।

আপনি বলেছেন নতুন ব্যাংকের দরকার নেই। কিন্তু আমরা দেখছি, গত এক যুগে ডজনখানেক নতুন ব্যাংক এসেছে। দেশের অর্থনীতির আকারও অনেক বড় হয়েছে। আপনার মতে, এ আকারের অর্থনীতিতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কতগুলো ব্যাংক থাকলে ভালো হতো?

কোনো সন্দেহ নেই, দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। কিন্তু অর্থনীতির আকার এতটা বেড়ে যায়নি যে নতুন ব্যাংক দিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর কার্যকলাপ বাড়ত। এটি হলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সুস্থ হতো। কিন্তু আমরা দেখছি, নতুন ব্যাংক এসে একই শ্রেণীর গ্রাহক, আমানত ও ঋণের পেছনে ছুটেছে। নতুন ব্যাংকগুলো নতুন কোনো উদ্ভাবন করেনি। বরং ব্যাংক খাতের প্রতিযোগিতা অসুস্থ করে তুলেছে। বাংলাদেশের ব্যাংক সংখ্যা ভারতের তুলনায়ও অনেক বেশি। সমগ্র ভারতে কার্যক্রম পরিচালনা করে, এমন ব্যাংকের সংখ্যা খুবই কম। তাদের আঞ্চলিক অনেক বড় ব্যাংক আছে। কিন্তু রাকাব ছাড়া আমাদের কোনো আঞ্চলিক ব্যাংক নেই।

ব্যাংকের পরিচালক পদটি কি লাভজনক হয়ে উঠল? সবাই পরিচালক হতে চাইছে…

এ পদ আগে লাভজনক ছিল না। এখনো তাত্ত্বিকভাবে লাভজনক নয়। পর্ষদের সভায় অংশ নিলে পরিচালকরা নির্দিষ্ট অংকের সম্মানী পান। এর অংক ১০ হাজার টাকারও কম। এ ধরনের সম্মানী যেকোনো কোম্পানিতেই হয়। কিন্তু ব্যাংকে পরিচালক পদটি ম্যানিপুলেট করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংক একটি বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান। এটি অন্য যেকোনো কোম্পানি থেকে আলাদা। জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ঋণ দেয়। ব্যাংক কাকে ঋণ দিতে পারবে, আর কাকে দিতে পারবে না সেটি আইনে নির্ধারণ করা আছে। অন্য কোম্পানির তুলনায় ব্যাংকের স্বকীয়তা ছিল এখানে। কিন্তু পরিচালকরা ম্যানিপুলেট করে ব্যাংককে একটি সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। সবচেয়ে খারাপ হলো, ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে ঢুকেছেন। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য নিজের ব্যবসা সমৃদ্ধ করা। এজন্য তারা নিজ ব্যাংক থেকে অন্য ব্যবসায়ীকে ঋণ দিচ্ছেন। আর অন্য ব্যাংক থেকে নিজেরা ঋণ নিচ্ছেন। এভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের ভাগাভাগি হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আসা খুব খারাপ দৃষ্টান্ত হয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদ ব্যাংকে চলে এসেছেন। ব্যবসায়ীরাও মোটাদাগে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।

দেশে ডলার সংকট শুরুর পর আমরা দেখছি, বেশকিছু বড় গ্রুপ, যাদের ব্যাংক নেই, তারা ব্যাংকের মালিকানায় যেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। কারণ যাদের ব্যাংক আছে, তাদের এলসি আছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা ব্যাংককে আরো লোভনীয় করে তুলছে কিনা?

হ্যাঁ, হতে পারে। ব্যাংক পরিচালিত হয় আমানতকারীদের অর্থে। শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে কিছু পরিচালক পর্ষদে বসেন। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার জন্য পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু কোনো স্বতন্ত্র পরিচালক পর্ষদের কোনো সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করছেন বলে আমরা শুনিনি। পরিচালকদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরাই স্বতন্ত্র পরিচালক হচ্ছেন।

পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পেশাদারত্বের সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করলে এমনটি হতো না। যোগ্য ব্যক্তিকে ঋণ দিলে ব্যাংক এতটা লোভনীয় হয়ে উঠত না। অ্যাকসেস টু ফাইন্যান্স যৌক্তিকভাবে হয় না বলেই এ অবস্থা। আরেকটি খারাপ দিক হচ্ছে, চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বিএবি, এবিবি ও ব্যবসায়ীদের ফেডারেশনগুলো এখন যেকোনো বিষয়ে চাপ দিচ্ছে। তাদের প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে গভর্নর হোটেলে বসে সিআরআর কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশে ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। গত এক দশকে নতুন অনেক ব্যাংক এলেও দুর্বল কোনো ব্যাংক মার্জার বা অ্যাকুইজিশন হয়নি। আপনি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে যদি বলেন, কতটা সাহস আপনাকে দেখাতে হয়েছিল?

এ ব্যাংকটা অনেক বিতর্কিত ছিল। আল-বারাকা ব্যাংক থাকা অবস্থায়ও ট্রাক রেকর্ড ভালো ছিল না। নাম পরিবর্তন করে পরে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক রাখা হলো। পুনঃঅর্থায়ন করে তাদের টাকাও দেয়া হতো মাঝেমধ্যে। কিন্তু যখনই টাকা দেয়া হতো, সে টাকাগুলো উধাও হয়ে যেত। বিভিন্ন শাখায় ব্যাংকের চেক ডিজঅনার হচ্ছিল। মাঝেমধ্যেই আমাদের কাছে অভিযোগ আসত। ব্যাংকটির মৌচাক, বংশালসহ কয়েকটি শাখায় ঝামেলা হয়েছিল। ভালো একজন ব্যাংকারই এমডি ছিলেন। তখন চেয়ারম্যানের ওপর নির্ভর না করে আমি ব্যাংকটির মালিকপক্ষকে ডাকলাম। নিজেরা একটি নিরীক্ষা করলাম। নিরীক্ষা দলের কর্মকর্তারা আমাকে বললেন, ‘স্যার অবস্থা খারাপ। পর্ষদের যোগসাজশে ব্যাংকের টাকা মৌচাক ও বংশাল শাখার মাধ্যমে বের হয়ে যাচ্ছে।’ টাকা স্থানান্তর করা হতো, কিন্তু কী কারণে করা হচ্ছে, সেটি পাওয়া যেত না। এভাবে কয়েকশ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। আমি ব্যাংকটির তৎকালীন মালিকপক্ষকে ডেকে টাকা ফেরত দিতে বললাম। তারা কিছুদিন সময় চেয়েছিল। কিন্তু যৌক্তিকতা না থাকায় খুব বেশি সময় দেয়া হয়নি।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকপক্ষই টাকা লোপাট করছিল বলে কি আপনাদের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল?

হ্যাঁ, ব্যাংকটির মালিকপক্ষই টাকা-পয়সা সব নিয়ে চলে গেছে। তবে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। পর্ষদকে অন্ধকারে রেখেই মালিকপক্ষ কিছু ব্যাংকারের সহযোগিতায় টাকা বের করে নিয়েছে।

ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের আপত্তি এসেছিল?

ওই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সাহেব একদিন হঠাৎ বললেন, ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বন্ড ছাড়বে।’ এজন্য দুজন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেয়া হলো। তারা আমার কাছে এলেন। আমি বললাম, ‘এটা কোনো কথা হলো? একটি ডিফল্ট ব্যাংক, এরা বন্ড ছাড়বে!’ শেষ পর্যন্ত তারা বন্ড ছাড়তে পারেনি। আমি বললাম, ‘ব্যাংকটির বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে হবে।’ তাদেরকে সময় দেয়ার প্রস্তাব এসেছিল। আমি বলেছি, ‘অনেক সময় দেয়া হয়েছে। এটিকে অধিগ্রহণ করতে হবে।’ একটি কমিটি করে দেয়া হলো। অর্থমন্ত্রী তার সময়ে একটি ব্যাংক দেউলিয়া হবে, এটি চাচ্ছিলেন না।

অর্থ সচিব বললেন, ‘আসুন আমরা আলাপ করি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রস্তাব পাঠান।’ আমি বললাম, ‘এটি তো সম্ভব নয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন লাগবে না। গভর্নর যদি বিবেচনা করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারে।’ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদে ব্যাংকটি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত প্রস্তাব ওঠে। পর্ষদে সেটি পাস হওয়ার পর অধিগ্রহণ করা হয়।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকপক্ষ ও সরকার থেকে যে প্রতিক্রিয়া এসেছিল তা কীভাবে মোকাবেলা করলেন?

ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করার সংবাদ টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় প্রচার হয়। এ সংবাদ থেকেই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জেনেছিলেন। ব্যাংকটির মালিকপক্ষ থেকে এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগও গিয়ে থাকতে পারে। অর্থমন্ত্রী কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছেন বলে শুনেছি। প্রধানমন্ত্রী জানতে চাচ্ছিলেন, এ-সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ তার কাছে কখন এসেছিল। তিনি না জেনে স্বাক্ষর করলেন কীভাবে? তখন প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হলো, এ-সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ তার কাছে যায়নি। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।

পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাকলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি ব্যাংকটি নিয়ে নিলেন? এখনো সময় আছে, ব্যাংকটি মালিকপক্ষকে ফেরত দেন।’ আমি বললাম, ‘মালিকপক্ষ কি ৮০০ কোটি টাকা ফেরত দিতে পারবে?’ প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমি তো শুনেছি ১০০ কোটি টাকা।’ আমি আবারো ৮০০ কোটি টাকা বের করে নেয়ার কথা জানালাম। এরপর প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘এত টাকা কীভাবে দেবে?’ তখন বললাম, ‘সরি ম্যাডাম, আমরা ব্যাংকটি ফেরত দিতে পারব না। টাকা ফেরত দিলে তবেই আমরা সিদ্ধান্ত উইথড্র করব। এখন যদি ব্যাংকটি ফেরত দেয়া হয়, তাহলে পুরো ব্যাংক খাত নষ্ট হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকলে অন্যরা ভয় পাবে। নইলে অন্য ব্যাংকগুলোরও একই পরিস্থিতি হবে। যদি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে আপনি অন্য কাউকে দায়িত্ব দেন। আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাকে পদত্যাগ করতে বলেননি।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের সিদ্ধান্ত সঠিক। ব্যাংকটিকে সামনে এগিয়ে নেন।’

আপনি চলে আসার পর প্রায় ১৪ বছর পার হয়েছে। কিন্তু আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এখনো দুর্দশার মধ্যেই আছে। এক্ষেত্রে দায়টা কার?

ওরিয়েন্টাল ব্যাংক মালয়েশিয়াভিত্তিক আইসিবি গ্রুপ কিনে নিয়েছিল। ব্যাংকটি বিক্রির টেন্ডারে তারাই সর্বোচ্চ দরদাতা ছিল। গ্রুপটির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক পরিচালনার অভিজ্ঞতাও ছিল। কিন্তু মামলাসহ নানা কারণে ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে। তবে ব্যাংকটি উন্নতি না করার ক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে বেশি দোষ দেব কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ ব্যাংককে সঠিকভাবে গাইড করা হয়নি। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের শাখাগুলো খুব ভালো জায়গায় খোলা হয়েছে। ব্যাংকটি সঠিকভাবে পরিচালনা করলে এটি ঘুরে দাঁড়াতে পারত।

যে প্রেক্ষাপটে আপনি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছিলেন, একই ধরনের পরিস্থিতি এখন দেশের অনেক ব্যাংকেই বিরাজমান। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করতে পারে?

হ্যাঁ, আপনি যথার্থই বলেছেন। দেশের অনেক ব্যাংকের পরিস্থিতিই এখন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মতো। সাত-আটটি ব্যাংক নিয়মিতভাবে সিআরআর সংরক্ষণ করতে পারছে না। প্রভিশন বা সঞ্চিতি ও মূলধন ঘাটতিও রয়েছে দেশের এক ডজনের বেশি ব্যাংকে। খেলাপি ঋণের উচ্চহারের কারণে কিছু ব্যাংকের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। পরিচালনা পর্ষদে সুশাসনের বালাই নেই, এমন ব্যাংকের সংখ্যাও অনেক। রাজনীতি, ব্যবসা, ব্যাংকসহ সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। খারাপ ব্যাংকগুলোকে পরিস্থিতি উন্নতি করতে সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। উন্নতি করতে না পারলে মার্জার, অ্যাকুইজিশনের মতো পদক্ষেপের দিকে যেতে হবে। সব ব্যাংককে একই চোখে দেখার নীতিতে চলতে হবে। ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার কার্যকর পদক্ষেপও নিতে হবে।