- খন্দকার হাসনাত করিম
- ২০ জুলাই ২০২২, ১৯:৫৮
দুর্নীতি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাসা বেঁধেছে। দুর্নীতির সাথে তুলনা চলে ক্যান্সার রোগের। ক্যান্সারের কোষ যেমন দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক কোষগুলোকে নষ্ট বা অকার্যকর করে দেয়, দুর্নীতিও তেমনি ক্ষমতার বাহন হয়ে দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের দেহে সংক্রমিত হয়। এ জন্যই লর্ড অ্যাকটন বলেছিলেন ‘Power corrupts. Absolute power corrupts absolutely.’ (অর্থাৎ ক্ষমতা দুর্নীতির কারণ হয় এবং ক্ষমতা যত প্রবল হয় দুর্নীতি ততই অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে)। সাত লাখ টাকা দিয়ে যে দেশে বালিশ নিচে থেকে উপরে তুলতে হয়।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে যেমন প্রকাশিত হয়েছে- জাতীয় আবহাওয়া অধিদফতরের সদ্য নির্মিত চার কোটি টাকার ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় দেখানো হয়েছে আট কোটি টাকা। এ সব উপসর্গ দেশে বিরাজমান সীমাহীন দুর্নীতির ভয়ঙ্কর মাত্রার পরিচয় দিচ্ছে। অসহায় ও অবরুদ্ধ ভিন্নমতাবলম্বী কিংবা মৃতপ্রায় বিরোধী দলগুলো নিশ্চয়ই দুর্নীতি করার সাহস বা সুযোগ কোনোটিই পায় না। তাহলে বলার অপেক্ষাই রাখে না, দুর্নীতি কারা করে কিংবা কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দুর্নীতি নামক বিষবৃক্ষটি এই দেশকুঞ্জে এত বড় মহিরুহ হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গক্রমে এটিই আজ আলোচনা করার বিনীত প্রয়াস নেব যে, দুর্নীতি আমাদের গোটা জাতীয় অর্থনীতির কী ও কতটা ক্ষতি করছে। গত কয়েক বছরে বিশ্বের বহু দেশে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে তার পেছনে ছিল বা রয়েছে ‘লাগামহীন’ দুর্নীতি। শুরু হলো গ্রিস হয়ে, তারপর ঘটল লেবানন। তারপর পাকিস্তান। সর্বশেষে ঘটল শ্রীলঙ্কায়। এ দেশগুলোর ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার তুলনা চলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপের দেশগুলোর সাথে, যাদের রক্ষা করতে আমেরিকা সেদিন গঠন করেছিল বিশাল ‘মার্শাল মহাপরিকল্পনার তহবিল’।
দুর্নীতির কারণে আমাদের দেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবেই নয়, নৈতিক মূল্যবোধের ধস, বিশৃঙ্খলা, অপরাধ, মাদক, যৌন কেলেঙ্কারি- এসব দিক থেকেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে গণতন্ত্রও বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার সমীকরণের ফলে যারা যখনই ক্ষমতায় যাচ্ছেন তারা ক্ষমতা ছাড়ার ‘লোকসান’ মেনে নিতেই পারছেন না। প্রকারান্তরে যারা ক্ষমতার গদি লাভে ব্যাকুল তারাও নতুন করে দুর্নীতির ‘স্বপ্ন’ দেখছেন। তা না হলে ক্ষমতা বিষয়টি এত লোভনীয় কেন? ক্ষমতা যদি সেবা ও কল্যাণের সাধনাই হতো তাহলে ক্ষমতার ব্যাকুলতা এতটা তীব্র হতে পারত না। ক্ষমতার সাথে নীতি আদর্শের বিয়েবিচ্ছেদের কারণেই ক্ষমতা এখন একটি পণ্য ও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতই তীব্র।
ইউরোপের দেশগুলোয় এখন দুর্নীতি অনেকটাই কমে এসেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, বিশেষ করে আইনসভায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও বিচারালয় স্বাধীনতা ভোগ করায় দুর্নীতির মাত্রা ইউরোপে সর্বকালের নিম্নতম স্থানে সীমিত করা গেছে। ফলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা কিংবা ক্ষমতা লাভের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠার সংস্কৃতি থেকে মহাদেশটি ‘নাজাত’ পেয়েছে। অথচ এখন থেকে দুই-আড়াইশ’ বছর আগেও ইউরোপ ছিল দুর্নীতির ‘প্লেগ-রোগ’-এ আক্রান্ত। এই দুর্নীতির বিমার থেকেই ইউরোপ সারা জগতে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন ও শোষণ-দমন-দুঃশাসনের জাহাজ ভাসায় দরিয়ায়। ঔপনিবেশিকতার যুগ অবসানে সেখানে স্বৈরাচার আর স্বেচ্ছাচার ফিরে আসেনি। কায়েম হয়েছে উদার নৈতিকতাবাদ ও আইনের শাসন।
ফলে গণতন্ত্র ইউরোপে শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক প্রথার রূপই লাভ করেনি, তাদের সমাজ, স্থানীয় শাসন ও পরিবারেও গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতার অন্ধকার অপসারিত হয়ে কল্যাণ ও সেবার ‘সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বেড়েছে উন্নয়ন, উৎপাদন, উদ্ভাবনা ও জ্ঞানের শাসন।
আমেরিকায় দুর্নীতি নিম্নগামী নয় বলে এখনো সে দেশে ‘কাউবয় গণতন্ত্র’ চলছে। সরকার, প্রশাসন, অঙ্গরাজ্য, সিভিল সোসাইটি কেউই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের খোলা বাজারকে বন্ধ করতে পারছে না। প্রতি মাসে অস্ত্রধারীদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। অন্যান্য অপরাধ বা ‘নেশাতন্ত্রের’ কথা না হয় বাদই দিলাম। পুরো পৃথিবীতে যত মাদক বিক্রি হয় তার অর্ধেকেরও বেশি বিক্রি হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। নৈতিক অধঃপতনে বিশ্বের প্রধানতম প্রতিযোগী খোদ আমেরিকাই। তারা গর্ভপাত অনুমতি দিচ্ছে; সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়েরও অনুমতি দিচ্ছে। ইউরোপ থেকেই তারা গেছে। কিন্তু ইউরোপের আধুনিক ধ্যান-ধারণা, দর্শনের ধারে কাছেও তারা নেই। ইউরোপ চাচ্ছে যুদ্ধ থামাতে; আমেরিকা চাচ্ছে যুদ্ধ বাধাতে।
ইউরোপ মানবতার জন্য সীমান্ত খুলে দিচ্ছে; আমেরিকা সীমান্তে কেবল কাঁটাতারই বসাচ্ছে না, উচ্চভোল্টের বিদ্যুৎ সংযুক্ত করেও ‘অনুপ্রবেশ’ প্রতিহত করছে। কারা করছে, যাদের পূর্বপুরুষরাই একদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে সেখানে অনুপ্রবেশ করেছিল। এই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বজুড়ে আজ ‘বেহায়াতন্ত্র’ কায়েম করা হচ্ছে, এই বিকৃতির প্রধান পুরোহিতই হলো যুক্তরাষ্ট্র। অথচ জাতিসঙ্ঘের কল্যাণধর্মী, মানবিক কর্ম তহবিলে চাঁদাটুকু দিচ্ছে না তারা। কথায় যেমন বলে, ‘ভাত দেয়ার ভাতার নয়; কিল দেয়ার গোসাই’। ভাবতে অবাক লাগে, এই কি সেই জেফারসনের যুক্তরাষ্ট্র, এই কি সেই মনরোর যুক্তরাষ্ট্র?
দুর্নীতিতে পর্যুদস্ত হয় নৈতিকতা। দুর্নীতি শাসকপক্ষের কাঠামোর মধ্যেই গড়ে তোলে গুপ্তদল বা উপদল। দুর্নীতিলব্ধ অর্থসম্পদের বিলি বণ্টন থেকে জন্ম নেয় অন্তর্দলীয় কোন্দল-কোটারি। বিনষ্ট হয় রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা। বিগত সাধারণ ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনকালে দেখা গেছে অন্তর্দলীয় রেষারেষি-সঙ্ঘাত কতটা নির্মম ও প্রাণঘাতী হতে পারে। শাসকদলের মধ্যে দুর্নীতির হালুয়া-রুটি বখরা নিয়ে এদেশে রাজনীতিবিদরা কিভাবে অসাংবিধানিক শক্তিকে রাজনীতিতে টেনে আনে এটি সামরিক জান্তাপ্রধান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা, আইয়ুব খানের আমল থেকে দেখে আসছি। তাই বলা হয়ে থাকে, দুর্নীতির অসহায় বলি হয় গণতন্ত্র নিজেই। দুর্নীতির দ্বারা অর্থসম্পদের পাহাড় বানানো এক ধরনের রাজনৈতিক-মানসিক বিকারও বটে। ক্ষমতাবানদের দৃঢ় বিশ্বাস, টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে, কর্মী পালা যাবে, সরকারি লোকজনকে ‘ম্যানেজ’ করা যাবে এবং বিচার-সালিশকেও প্রভাবিত করা যাবে। ফলে ক্ষমতাকে আরো জোরদার, স্থায়ী ও অপ্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলা যাবে।
অনেকে মনে করেন, আর্থিক শক্তিই সামাজিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। আবার যে ব্যবসায়ীরা ঘুষ, উৎকোচ, কমিশন বখরা দিয়ে ক্ষমতার সাথে বন্দোবস্তে গেলেন তারাও ওঁৎ পেতে থাকেন কত দ্রুত ও কত নিশ্চিতভাবে তারা তাদের ‘বিনিয়োগ’ উসুল করতে পারবেন। তাদের কারণেই সৃষ্টি হয় দুর্নীতির একেকটি দৃষ্টান্তমূলক ‘কাণ্ড!’ মুখে মুখে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সেসব ‘কাণ্ডের’ গুপ্তকথা। প্রান্তিক পর্যায়ের কিছু ঘটনা জাতীয় গণমাধ্যমে কদাচিৎ আসে। তবে সাংবাদিকতা আজ দুর্নীতির ভয়ে জড়সড়। নীতিকে গ্রাস করেছে ভীতি। শাসকের কোপানল আর ক্ষমতার রোষানল যে কী জিনিস, ভুক্তভোগী ছাড়া তার ধারণাও কেউ করতে পারবে না। ইতোমধ্যেই চাউর হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নির্যাতন ও দমননীতি বিশ্ব-উপমায় পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতি ও ‘লুটপাটতন্ত্র’ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার এগুলো একেকটি বড় কারণ। দুর্নীতির ‘বিষবৃক্ষ’ লালনের এই বাস্তবতা কমবেশি সব শাসনামলেই ঘটেছে। তফাৎটা কেবল মাত্রার। স্বৈরাচারী শাসনামলে দুর্নীতির ‘কাণ্ডগুলো’ এত জানাজানি হয়নি, তার কারণ তখন সোশ্যাল মিডিয়ার খোলা আকাশ ছিল না। তা ছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল অবরুদ্ধ, দেশ চলত সামরিক শাসনে।
রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সবচেয়ে বড় ও কৌশলী খেলোয়াড় হলো সরকারি কর্মকর্তা, আমলাতন্ত্র। তারাই ‘কাণ্ডের’ বাস্তবায়নকারী। অথচ কৌশলে তারা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’। ‘আদিষ্ট হইয়া জানাইতেছি’ এই মর্মে ব্রিটিশ রাজকর্মকর্তাদের যে কৌশলগত ‘ইমিউনিটির’ ঢাল তাদের হতে তুলে দিয়ে গেছে, সেই রক্ষাব্যূহ আজো তাদের সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রণীত বিশ্বব্যাপী সুশাসন সূচকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি এমন এক ধরনের অনঁংব যা দ্বারা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত লাভের হাতিয়ার করে তোলা হয় এবং একই সাথে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত ভোগের নিমিত্ত করে তোলা হয়। বলা হয়েছে, ‘Corruption is the abuse of public management position of personal and third party benefits against those interest of society and its institutions.’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয় ‘Corruption can be defined as the perception of extortions, payoffs, bribery, collection of charges, fees, illegal gifts, illicit contributions, tax evasion or fraud, open public robbery, nepotism, unlawful appropriation of public funds or state property and the abuse of public authority,’
দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের এই সন্ধি বা দুষ্ট যোগসাজশের সাথে আমরা ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই পরিচিত। তবে আগে দুর্নীতি হতো রেখেঢেকে, সীমার মধ্যে। এখন দুর্নীতি হচ্ছে প্রকাশ্যে ও নির্ভীক চিত্তে। চঁনষরপ Public Interest এখন পরিণত হয়েছে Group Interest-এ। দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা শ্রেণী। কেননা, সততা ছাড়া সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় না। দুর্নীতি সেই সৃজনশীলতার মূলে কুঠারাঘাত করে। ফলে উদ্যম ও সৃজনশীলতার মূল্যে দুর্নীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে গড়ে ওঠে ‘ত্রিভুজ’ প্রেম- যে নিষিদ্ধ গলিতে জনগণের প্রবেশাধিকার নেই। জনগণের স্বার্থ সেখানে Out-of-Bound.
কাজেই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শ্রমিক, কর্মী, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা ও সংগঠকদেরও উচিত হবে দুর্নীতির ‘শূন্য সহনশীলতা’ বা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সাথে সহমত প্রকাশ করা এবং একাত্ম হওয়া।