ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৩৮ জনের মৃত্যুর কথা জানা গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে আরও বহু মানুষ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এরই মাঝে সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন পৃথকভাবে ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বরগুনা জেলা প্রশাসন নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং চিকিৎসাধীনদের ১৫ হাজার করে আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ও প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে দেড় লাখ করে টাকা দেবে বলে জানিয়েছে।
আমাদের দেশে যখনই কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে তখনই সরকারের তরফ থেকে এমন সাহায্যের ঘোষণা শোনা যায়—হোক সে কারখানা দুর্ঘটনা, বাস দুর্ঘটনা কিংবা নৌযান দুর্ঘটনা। রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও সরকারের কাছে সাহায্যের দাবি জানাতে ভুলেন না। তবে তাদের এই দাবি যত না মানবিক বিবেচনা প্রসূত, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক অভিসন্ধিজাত, এ কথা সবাই জানেন। সরকারও তার মুখরক্ষা এবং বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এ জাতীয় দাবি মেনে নেয়। আজকের আলোচ্য ঘটনার বেলায় অবশ্য দাবি জানানোর আগেই প্রশাসন এবং মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সাহায্যের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বেশ প্রোঅ্যাক্টিভ মনে হচ্ছে।
দুর্ঘটনা পরবর্তী এরকম সাহায্যের ২টি দিক আছে। প্রথমত, এই ধরনের সাহায্যের মধ্য দিয়ে ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আড়াল করে তাকে বা তাদেরকে জনরোষ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস। দ্বিতীয়ত, পরোক্ষভাবে ঘটনার দায়িত্ব সরকারের নিজের ঘাড়ে তুলে নেওয়া। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টি আমাদের দেশে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। বিদেশে, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতে, এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে কোনো দুর্ঘটনার দায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভারতের কিংবদন্তি নেতা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর গল্প তো সবাই জানেন—যিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। এমন আরও নজির সভ্য দেশে রয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ এবং জনস্বার্থের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও এরকম দায়বদ্ধতার কোনো প্রমাণ জনগণের সামনে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। উল্টো অনেকসময় দুর্ঘটনার পেছনে কোনো এক অদৃশ্য নন্দ ঘোষকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি নাহয়—’আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’ বলে স্রষ্টার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাই। এসবের কারণও খুবই স্পষ্ট। সোজাসাপ্টা কথায়, আমাদের দেশে মন্ত্রী-মিনিস্টারগণ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নন। তাই জনগণের কাছে জবাবদিহিতারও কোনো প্রশ্ন নেই। একথা সুবিদিত যে, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়গণ কেবলমাত্র তাদের দলের কাছেই দায়বদ্ধ। অনেক সময় দলের প্রতিও তাদের দায়বদ্ধতা খুবই দুর্বল, তাদের আসল দায়বদ্ধতা তাদের দলীয় প্রধানের কাছে। এর ফলে এই যে গত দেড় দশকে দেশে এতসব দুর্ঘটনা ঘটল, যার ফলে হাজারেরও বেশি প্রাণ অকালে ঝরল, তার কোনো একটিরও যথাযথ তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হয়নি।
এবার আসা যাক, দুর্ঘটনা পরবর্তী সাহায্যের প্রসঙ্গে। দুর্ঘটনায় কেউ নিহত বা আহত হলে তাকে সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের বিষয়টি খুব সাধারণ প্র্যাকটিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর যে একটি নৈতিক দিক আছে—তা অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না। তা হলো—সরকার মানে কোনো ব্যক্তি নয়। একটা দেশের সকল জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত এবং অবিচ্ছেদ্য সত্তার নামই হলো সরকার। সেই হিসেবে জনগণই সরকার, আবার জনগণ সরকারের অংশও বটে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায়ই সরকার চলে। তাই কোনো অপরাধীর অপরাধের দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে কাউকে সাহায্য করার নৈতিক কোনো অধিকার সরকারের নেই। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, দুর্ঘটনায় যারা নিহত বা আহত হন, সরকারের টাকায় তাদেরও অংশীদারিত্ব রয়েছে। তাই নিহতের টাকাই নিহতের পরিবারকে প্রদান একধরনের চাতুর্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে, যার কারণে বা যার গাফলতিতে দুর্ঘটনা ঘটে, সরকার কর্তৃক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের অপকর্মকে উৎসাহিত করা হয়। কারণ তারা বুঝে যায়, কোনো ঘটনা ঘটলে তো সামাল দেবার জন্য সরকারই আছে।
এই যে ঝালকাঠিতে ‘অভিযান-১০’ এ অগ্নিকাণ্ডটি ঘটল, তার সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত জানা না গেলেও প্রাথমিক তথ্য থেকে যা বোঝা যাচ্ছে—লঞ্চটির ইঞ্জিনের পাশেই একটা ক্যান্টিন ছিল যাতে এক বা একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। কোনো একটি সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। এ কথাটা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই, যে পাঁচ শতাধিক যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটা নৌযানের ইঞ্জিনের পাশে কোনো দাহ্য পদার্থ রাখা উচিত নয়। তারপরও রাখা হয়েছে। গাফিলতি কার? বিনা দ্বিধায় বলা যায়, যে বা যারা এই নৌযানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে তাদের। এবং সর্বোপরি এর মালিকের। আর, এ কথাটা বুঝতেও আইন বিষয়ে কোনো ডিগ্রির দরকার নেই যে দুর্ঘটনার দায় যার—ফলাফলের দায়ভারও তার। তাই ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন যদি আসে, তা ওই নৌযানের মালিক তথা কোম্পানিকেই বহন করতে হবে। জনগণ দুর্ঘটনার শিকার হবে, আবার জনগণের পয়সা থেকেই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে—এটা অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, গত ১৫ ডিসেম্বর কাগজে দেখলাম ঠাকুরগাঁওয়ে খিজমত আলী নামে একজন ওমানে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সময় ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এর ফলশ্রুতিতে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করলে বিষয়টি সে দেশের আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অবশেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খিজমত আলীকে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। এই খবরটি সরকার খুব ফলাও করে প্রচারও করেছে। ভালো খবর নিঃসন্দেহে। তাহলে নিজ দেশে আমরা কেন তা চালু করতে পারব না? সরকার কঠোর হলে অবশ্যই পারব। তাই, সব ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় জনগণকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে দায়ী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-কোম্পানির কাছ থেকে তা আদায় করা হোক। এটিই হবে নৈতিক বিচার। নয়তো, দুর্ধর্ষ মুনাফালোভীদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। আর, বাড়তেই থাকবে এ ধরনের দুর্ঘটনা। সুগন্ধার জলে শুধুই ছড়াবে পোড়া লাশের গন্ধ।
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)