
সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত নাগাল্যান্ড রাজ্যটি ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। এর উত্তর ও পশ্চিমে আসাম, পূর্ব দিকে মিয়ানমার, উত্তরে অরুনাচল এবং দক্ষিণে মনিপুর। নাগাল্যান্ডের আয়তন ১৬ হাজার ৫৭৯ বর্গকিলোমিটার (ছয় হাজার ৪০০ বর্গমাইল)। এটি ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্য। নাগা পর্বতের অবস্থান এ রাজ্যে। যার সবচেয়ে উচ্চতম শৃঙ্গ সারামতী। সারামতীর উচ্চতা ১২ হাজার ৬০০ ফুট। নাগাল্যান্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলো হলো ধানসিঁড়ি, দোয়াং, দিখু এবং ঝাঁজি। নাগাল্যান্ডের ভ‚খণ্ড পর্বতময় ঘন বৃক্ষে আচ্ছাদিত এবং গভীর নদী উপত্যকা বেষ্টিত। এখানে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য রয়েছে। নাগাল্যান্ডে সাধারণত উচ্চ আর্দ্রতাবিশিষ্ট বর্ষা জলবায়ু থাকে। এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ মিলিমিটার (৭০ ইঞ্চি থেকে ১০০ ইঞ্চি)।
নাগাল্যান্ডে ৬০টি আসনের একটি বিধানসভা রয়েছে। রাজ্যটি থেকে ভারতের রাজ্যসভায় (উচ্চকক্ষে) এবং লোকসভায় (নিম্নকক্ষে) একজন করে দু’জন সদস্য নির্বাচনের বিধান রয়েছে। এখানে স্থানীয় সরকারের ১৬টি প্রশাসনিক জেলা রয়েছে, যথা- মোকোকচুং, তুয়েনসাং, মোন, ওখা, জুনহেবোতো, ফেক, কোহিমা প্রভৃতি। নাগাল্যান্ডে বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক স্থান রয়েছে। যেগুলো বিশ্বের সব পর্যটককে কাছে টানে।
১৯৬৩ সালের ১ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ড ভারতের ১৬তম রাজ্য হিসেবে ঘোষিত হয়। এর আগে নাগাল্যান্ড কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছিল। নাগাল্যান্ডে ১৭টি ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে। রীতিনীতি, পোশাক এবং ভাষাসহ প্রত্যেকের নিজস্ব পৃথক সাংস্কৃতিক পরিচয় রয়েছে। রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। অবশিষ্টরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং কিছুসংখ্যক আদিবাসী রয়েছে যারা প্রকৃতিপূজারী।
রাজ্যটিতে সারা বছর মনোরম আবহাওয়া অনুভ‚ত হয়। এ মনোরম আবহাওয়ার কারণে রাজ্যটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে। রাজ্যের আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো হলো- স্টেট মিউজিয়াম, জপ্ফুশৃঙ্গ, জুকোও উপত্যাকা, কোহিমা গ্রাম, খোনোমা, জুলেকেঈ, জ্যোলোজিক্যাল পার্ক এবং ডিমাপুর। রাজ্যের রাজধানী কোহিমা শহরেও এমন কিছু স্থান রয়েছে যা এখানকার সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পরিদর্শনযোগ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবরস্থান, লাল ছাদবিশিষ্ট রিকনসিলিয়েন ক্যাথিড্রাল, বারা বস্তি, নাগাল্যান্ড মিউজিয়াম, নাগাল্যান্ড চিড়িয়াখানা এবং নাগাল্যান্ড উদ্যান প্রভৃতি।
বর্তমানে যে অঞ্চল নাগাল্যান্ডরূপে গঠিত হয়েছে তার প্রারম্ভিক ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম তথ্য জানা যায়। এমনকি ডিমাপুরে বেশ কিছু বড় ধরনের বেলে পাথরের স্তম্ভ রয়েছে, যেগুলো সম্বন্ধেও খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। ১৮৯০ সালে এ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঐতিহ্যগত প্রথায় অনুসৃত হেডহান্টিং (বিজয় নিদর্শনস্বরূপ প্রতিদ্বন্দ্বীর মস্তক ছেদন) প্রক্রিয়া বেআইনি ঘোষিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর এ নাগা অঞ্চল আসাম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সংস্থায় বিভক্ত হয়ে যায়।
পুরো নাগা উপজাতিদের এক রাজনৈতিক সংস্থা তীব্র আন্দোলন দ্বারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি করতে থাকে। ১৯৫৭ সালে কিছু সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ভারতীয় শাসনের অধীনে একটি একক নাগা প্রশাসনিক ইউনিটের প্রতিষ্ঠা করে। নাগা অধিবাসীরা তাদের কর দিতে অস্বীকার করে। একই সাথে অন্তর্ঘাতের একটি অভিযান চালিয়ে তারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার নাগাল্যান্ডকে ভারতের স্বশাসিত রাজ্য গঠনের সম্মতি দেয়।
নাগাল্যান্ডের অধিবাসী নাগারা ইন্দোমঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। সবচেয়ে বৃহত্তম জাতি কোন্যাক। এরপর রয়েছে এওস, তাংখুল, শেমা এবং অঙ্গামি। অন্য জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে লোঠা, শাংতাম, ফোম, চাঙ্গ, খিয়েমনুঙ্গম, ঈমচাঙ্গরে, জেলিয়াং, ছাকেসাং এবং রেঙ্গমা। এখানকার প্রধান প্রধান ভাষা হলো অঙ্গামি, আও, চাং, কোন্যাক, লোঠা, শাংতাম ও শেমা। নাগারা খুব বন্ধুবৎসল ও সুন্দর প্রকৃতির হয়।
নাগাল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ গ্রামে বসবাস করে। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, গ্রামের জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। অপর দিকে শহরাঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৩ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে। ১৯৬৭ সালে নাগাল্যান্ড অ্যাসেম্বলি ভারতীয় ইংরেজিকে নাগাল্যান্ডের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে এবং বর্তমানে এটি নাগাল্যান্ডে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ব্যতীত নাগামিজ ও অসমিয়া ভাষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
নাগাল্যান্ড রাজ্যটি কয়লা, চুনাপাথর, লোহা, নিকেল, কোবাল্ট, ক্রোমিয়াম এবং মার্বেলের মতো খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। যদিও নাগাল্যান্ডের মোট দেশজ উৎপাদনের বেশির ভাগ অবদান কৃষি ও বনায়ন।
নাগাল্যান্ডের প্রধান ফসল ধান, বাজরা, ভুট্টা এবং ডাল। আখ ও আলুর মতো অর্থকরী ফসলও কিছু অংশে জন্মে। কফি, এলাচ এবং চা পাহাড়ি এলাকায় অল্প পরিমাণে জন্মায়; যদিও এগুলো বড় পরিসরে চাষের সুযোগ রয়েছে। ধান এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ ধান চাষ করে জীবন নির্বাহ করে। ফসলি জমির প্রায় ৮০ ভাগ ধান চাষে ব্যবহৃত হয়। নাগাল্যান্ডে সীমিত আকারে বিভিন্ন ধরনের তৈলবীজ চাষ হয়। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজ্যটি পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করে না এবং খাদ্যের জন্য রাজ্যটি ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মুখাপেক্ষী।
পর্যটনের অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও গত ৫ দশক ধরে বিদ্রোহ ও সহিংসতায় এটি সীমিত ছিল। অতিসম্প্রতি বেশ কয়েকটি ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ এবং বেসরকারি খাতের কোম্পানি সক্রিয়ভাবে নাগাল্যান্ডে পর্যটনের প্রচার করছে, যা একটি ক্রমবর্ধমান পর্যটনবাজার শুরু করতে সাহায্য করছে। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের দাবি, উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য এবং কৌশলগত অবস্থান নাগাল্যান্ডকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন খাত ব্যবহার করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। নাগাল্যান্ডে পর্যটনের মূল বিষয় হলো এর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং বন্যপ্রাণীর প্রদর্শনী। পর্যটন অবকাঠামোর দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটি অতীতের মতো এখন আর সমস্যা নয়। স্থানীয় উদ্যোগ এবং পর্যটনের অগ্রগামীরা, কাউন্সিল, গ্রামের প্রবীণ, গির্জা এবং যুবকদের অংশগ্রহণের সাথে জড়িত। এটি সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল পর্যটন মডেল প্রচার করতে শুরু করেছে।
প্রতি বছর ১ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে নাগাল্যান্ডে হর্নবিল উৎসব পালিত হয়। উৎসবটির পালন ২০০০ সাল থেকে শুরু হয়। রাজ্য পর্যটন দফতর এবং শিল্প ও সংস্কৃতি দফতর দ্বারা সংগঠিত হর্নবিল উৎসব একছাদের নিচে সাংস্কৃতিক প্রদর্শনের এক মিলনমেলা। এটি নাগা হেরিটেজ ভিলেজ কিসামাতে অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রায় কোহিমা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। নাগাল্যান্ডের সব উপজাতি এ উৎসবে অংশ নেয়। উৎসবের উদ্দেশ্য হলো নাগাল্যান্ডের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে পুনর্জীবিত করা এবং এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রদর্শন করা।
ডিমাপুর বিমানবন্দর হলো নাগাল্যান্ডের একমাত্র বিমানবন্দর। বন্দরটি থেকে কলকাতা, গুয়াহাটি, ইম্ফল এবং ডিব্রুগড়ে নির্ধারিত বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এটি ডিমাপুর থেকে ৭ কিলোমিটার এবং কোহিমা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
নাগাল্যান্ড প্রথম রেললাইনের সাথে সংযুক্ত হয়েছিল ১৯০৩ সালে যখন মিটারগেজ রেলওয়ে চট্টগ্রাম থেকে লুমডিং পর্যন্ত চলাচল করত। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সব রাজধানীকে ব্রডগেজ রেল সংযোগের মাধ্যমে সংযুক্ত করার ভারতীয় রেলওয়ের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে ধানসিঁড়ি থেকে শোখুবি ১৬ কিলোমিটার লাইন, দ্বিতীয় ধাপে শোখুবি থেকে খাইবং ৩০ কিলোমিটার লাইন এবং তৃতীয় ধাপে খাইবং থেকে জুবজ্যা ৪৫ কিলোমিটার লাইন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রকল্পের পুরো ধাপটি ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
নাগাল্যান্ডে তিনটি স্বায়ত্তশাসিত কলেজ রয়েছে। তা ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, একটি ভেটেরিনারি সাইন্স অ্যান্ড অ্যানিমাল হাজবেন্ড্রি কলেজ এবং তিনটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
নাগাল্যান্ডের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সবুজের গালিচা। দূর থেকে হাতছানি দেয় বিস্ময়, অ্যাডভেঞ্চার আর উপজাতীয় সংস্কৃতি। দুর্গম পাহাড়ি পথ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অনাবিল। শান্তি ও নির্মলতার প্রতীক নাগাল্যান্ড। হিমালয়ের পাদদেশে উপজাতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য লালিত ভারতের একটি সুন্দর রাজ্য। পৃথিবীজুড়ে নাগাল্যান্ড যেন বিস্ময়। প্রতি বছর আগস্ট-অক্টোবরে নাগাল্যান্ডে জাটিঙ্গা গ্রামে বৈরী আবহাওয়ায় পাখিদের স্বেচ্ছা মৃত্যু ঘটে। পাখিদের এ আত্মাহুতির বিষয়টি নাগারা ঈশ্বরের দান বলে মনে করে।
এখানকার ট্র্যাকিং বিশ্বজুড়ে সেরা। প্রাকৃতিক গুহা, পাহাড়, নদ-নদী পর্যটকদের আকর্ষণ করে। জাপফু চূড়ার উঁচু পাহাড়ি ঢাল ট্র্যাকিংয়ের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। নাগাল্যান্ডকে হস্তশিল্প আর কারুশিল্পের ঐতিহ্য বলা চলে। এখানকার কাষ্ঠ, বেত, বাঁশ ইত্যাদি তৈজসপত্র পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। বাঁশ ও বেতের কঞ্চি দিয়ে ঝুড়ি, ব্যাগ ও আসবাবপত্র এবং তুলা দিয়ে বোনা শাল ও জ্যাকেট পর্যটকদের নজর কাড়ে। রঙ, নকশা এবং অঙ্কনে রয়েছে নাগাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। পণ্যগুলো আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক রঞ্জক, পুঁতি এবং শামুকের খোলস। এখানকার তাঁতশিল্প, কাষ্ঠ খোদাই, মৃৎশিল্প, ধাতবশিল্প প্রভৃতিও বেশ জনপ্রিয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক