দুই বছরে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশ

 শাহেদ আলী ইরশাদ

দুই বছরে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশ

সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, ডলারের বিনিময় হারে টাকার পতনের প্রভাব পড়েছে পুরো আর্থিক খাতে। ব্যবসায়ীদের উচ্চ আমদানি ব্যয় মেটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার উৎস চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। উচ্চ আমদানি ব্যয়ের প্রভাব পড়েছে ভোক্তার কাঁধে। পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে এবং ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মার্কিন ডলারে বিদেশি ঋণ রয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় ডলারে একই পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে, যা টাকার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সূত্র মতে, চলমান ডলার সংকটের জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হয়, যার মধ্যে দেশে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম আসা এবং হুন্ডিতে লেনদেন ডলার সংকট আরও বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে।

বৈদেশিক মুদ্রা ডলার বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৫ মাসে (২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত) প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এ ছাড়াও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৪ কোটি বিক্রি করেছে, যা বাজারে ডলারের উচ্চ চাহিদা এবং সরবরাহকে সীমিত করেছে।

ডলার বিক্রির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রারও সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে অনেকগুলো ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। ২০২২ সালের জুন মাসে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ১৮২ কোটি ডলার থেকে চলতি বছরের ২৬ জুলাই ২ হাজার ৯৬০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১ কোটি ৬৭ লাখ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিনিময় হারের অস্বাভাবিক ওঠানামার ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারের বিনিময় হারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা কার্যকরী সমাধান নয়। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) লেনদেনের জন্য ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে, একটি সীমাবদ্ধ ব্যবস্থা তৈরি করেছে। আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত বিক্রিতে ডলারের এক দর নির্ধারণ করা হলেও, এটি সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত বা ভাসমান নয়। ফলে ডলারের উচ্চ চাহিদা মেটাতে জনসাধারণকে কার্ব মার্কেটের দিকে প্ররোচিত করে। বাফেদা ডলার বিক্রিতে এক দাম চালু হলেও ব্যাংকের ডলার কেনার ক্ষেত্রে এখনো দুই দাম চলছে। ডলার কেনার ক্ষেত্রে রপ্তানি বিল নগদায়নে প্রতি ডলারের দাম এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, আর রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে ১০৯ টাকা। তবে ব্যাংক খাত সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত দাম পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি রোধ এবং বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে স্থিতিশীল করতে ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে আসান এইচ মনসুর বলেন, দীর্ঘ সময়ের জন্য আমদানি কমিয়ে রাখা দেশীয় উৎপাদন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অনেক ব্যবসা কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি নির্ভরশীল। বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন সীমিত করার ফলে উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এদিকে আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলেছেন, ব্যাংক এবং হুন্ডিতে ডলারের বিনিময় হারের বড় পার্থক্য বৈধ চ্যানেল থেকে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স প্রবাহকে সরিয়ে দিতে পারে। ফলে আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শিগগিরই একটি সমন্বিত এবং বাজার ভিত্তিক একক বিনিময় হার চালু করা উচিত, যাতে টাকা এবং ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজার দ্বারা নির্ধারণ হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপের ফলে ডলার সংকট কমেছে। এলসি খোলা এবং নিষ্পত্তির ওপর মনিটরিং জোরদার এবং বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে বিধি-নিষেধ ছিল সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উপরন্তু, সরকার আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। মেজবাউল হক আশা করছেন, এই উদ্যোগগুলো অদূর ভবিষ্যতে বাজার স্থিতিশীল করতে আরও অবদান রাখবে।