দুই বছরের ব্যবধানে দেশে নতুন হ্যান্ডসেট বিক্রি কমেছে অর্ধেক

দেশে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে মোবাইলের গ্রাহক সংখ্যা পৌঁছে ১৯ কোটি ৩৬ লাখে। অথচ সরকারের একই সংস্থার তথ্য বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে দেশে নতুন মোবাইল ফোনের ব্যবহার কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। একই সঙ্গে কমেছে মোবাইল ফোনসেটের স্থানীয় উৎপাদনও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানুষ এখন নতুনের চেয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন সেটের দোকানগুলোয় বেশি ভিড় করছে। আবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আনা অবৈধ হ্যান্ডসেটের কারণেও লোকসানে পড়ছেন মূল ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোনসেট উৎপাদনও কমছে বিগত তিন বছর ধরে। কভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কারণে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি শ্লথ হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদকরাও মোবাইল সেট উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয় ৩ কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার। পরের বছর তা ২ কোটি ৩৩ লাখ ২১ হাজারে নেমে আসে।

দেশের মোবাইল ফোন উৎপাদক ও আমদানিকারকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছর দেশে গড়ে চার কোটির বেশি মোবাইল ফোনসেট বিক্রি হয়। তবে গত বছর এ খাতে প্রায় ধস নেমেছে। মূলত কভিড সংক্রমণের পর থেকেই দেশে মোবাইল বিক্রির হার কমতে শুরু করেছে।

মোবাইল ফোন অ্যাকসেসরিজ আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোমিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কভিডের পর থেকে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে মানুষ। সে কারণে তারা বিলাসপণ্য এড়িয়ে চলছে। যারা একবার মোবাইল ফোন কিনেছেন নতুন করে আর কিনছেন না। সে জন্যই নতুন মোবাইল ফোনের গ্রাহক কমেছে। তাছাড়া কিছুদিন আগেও মানুষের হাতে পর্যাপ্ত মোবাইল ফোন ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বিগত কয়েক বছর তাই বেশি বিক্রি হয়েছে। টেকসই পণ্য হওয়ায় তাই এখন বিক্রি কমে গেছে। সামনে হয়তো আবারো চাহিদা বাড়বে।’

এদিকে দেশের ডলার সংকট সামাল দিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। এতে চাপে পড়ে মোবাইল শিল্পের উৎপাদনে। এছাড়া বছর দুয়েক ধরে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করছে সরকার। এ কারণে মোবাইল হ্যান্ডসেটের দাম প্রতি বছরই ঊর্ধ্বমুখী। অনেক ক্রেতার সক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বিক্রিও কমেছে।

তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জহিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন সব সময় কেনার মতো বা নিত্যপণ্য নয়। আর এখনকার ফোনগুলোর স্থায়িত্ব অনেক বেশি, যার কারণে বিগত কয়েক বছর বিক্রি কমতে পারে। তাছাড়া দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখন কমে গেছে। ফলে ক্রেতারা চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন কেনার সক্ষমতা তৈরি করতে পারছেন না।’

বিদেশের উদাহরণ দিয়ে এ তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাইরের দেশে হ্যান্ডসেটের নতুন ভার্সন এলে অথবা ফিচার যুক্ত হলে মানুষ পুরনোটি বিক্রি করে নতুন ফোন কেনে। আমাদের এখনো সে সক্ষমতা তৈরি হয়নি। তাছাড়া কভিডের পর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষ নতুন মোবাইল ফোনসেট কেনাকে বিলাসিতা হিসেবে নিচ্ছে।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া ডলার ঘাটতির কারণে এলসি (ঋণপত্র) খোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে এ শিল্পের স্থানীয় উৎপাদনে ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। এসব কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের দাম বেড়েছে। আর দাম বাড়ায় কমেছে চাহিদা।

তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেলেক্সট্রা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিব আরাফাত বলেন, ‘চারটি বড় কারণে হ্যান্ডসেটের বাজারে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো ২০২১ সালটা ছিল কভিডকাল। তখন সবাইকে হোম অফিস করতে হয়েছে। তাই প্রযুক্তির অস্বাভাবিক চাহিদা তৈরি হয়। সে কারণে তখন অস্বাভাবিক হারে হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়েছে। এরপর পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক পর্যায়ে এলো তখন এ খাতের যে উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল, তা আর হয়নি। দ্বিতীয়ত, বাজার এখন অনিবন্ধিত ও অবৈধ হ্যান্ডসেটে সয়লাব। ফলে বৈধ হ্যান্ডসেটের বাজার ছোট হয়ে আসছে। ৪০-৫০ শতাংশের বেশি অবৈধ হ্যান্ডসেট দিয়ে বাজার ভর্তি। যেগুলো বিটিআরসিতে নিবন্ধিত নয়। তবে সংস্থাটি এগুলো বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই এর সমাধান হবে।’

বাজারের এ পরিস্থিতির জন্য আরো দুই কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘টুজি থেকে থ্রিজি, থ্রিজি থেকে ফোরজি এবং ফোরজি থেকে ফাইভজিতে রূপান্তরের সময় হ্যান্ডসেটের বড় ধরনের চাহিদা তৈরি হয়। তখন অনেক বেশি হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়। টুজি থেকে থ্রিজিতে কনভার্ট হওয়ার জন্য ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকার ব্যবধানের ফোনের প্রয়োজন হতো। কিন্তু থ্রিজি থেকে ফোরজি এবং ফাইভজিতে রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের বাজেটের ফোন প্রয়োজন হচ্ছে, যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তৃতীয় এ কারণেও কমেছে হ্যান্ডসেট বিক্রি। আর চতুর্থত, কভিডকালীনের পর থেকে ডলার সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এছাড়া সরকার আরোপিত ভ্যাটের বিষয় তো রয়েছেই। এসবের কারণে হ্যান্ডসেটের বাজার এখন নিম্নমুখী।’

মোবাইলসহ প্রযুক্তিপণ্যের ওপর করারোপের কারণে বাজারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে বলে জানান উৎপাদকরা। তবে সরকার কর সুবিধা দেয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে হ্যান্ডসেটের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল। গত অর্থবছরের আগে স্মার্টফোন আমদানিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর দিতে হতো। স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর ভ্যাট দিতে হয় ৩ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তাই দেশেই গড়ে ওঠে মোবাইল ফোনসেট উৎপাদনকারী ১৫টি প্লান্ট, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার লোকের। এখন স্থানীয়ভাবে তৈরি হ্যান্ডসেটে সরকারকে ভ্যাটও দিতে হচ্ছে। কারখানা থেকে শুরু করে পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের পর্যন্ত আরোপ করা হয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট। এছাড়া কমপক্ষে দুটি উপাদান দিয়ে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ শতাংশ। একইভাবে আমদানি যন্ত্রাংশ দিয়ে সংযোজিত হ্যান্ডসেটের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে গ্রে মার্কেট ব্যবসায়ীদের থেকে কোনো ধরনের রাজস্ব আয় হয় না। এ অবস্থায় কর কমানো সম্ভব না হলে অন্তত গ্রে মার্কেট নির্মূলে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে সরকার ও বিটিআরসির কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

দেশে বৈধ মোবাইল ডিভাইসের ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিটিআরসি ২০২১ সালে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) সিস্টেম চালু করেছিল। কিন্তু নকল, অননুমোদিত বা ক্লোন হ্যান্ডসেট ব্লক করার মতো প্রধান ফাংশনগুলো এখনো শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনইআইআরে বিনিয়োগ করেছে বিটিআরসি। তবে এখনো অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন ব্লক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। খুব শিগগিরই বিটিআরসি ফোন ব্লকের কার্যক্রম শুরু করবে। এ কাজটি শুরু হলে তখন অবৈধ ফোন আসা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।’

Bonik Barta