দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় মৌলভীবাজারের পানিবন্দী ৪৪ হাজার পরিবারে নেই ঈদের আমেজ

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper

বন্যা আক্রান্ত এলাকার ভুক্তভোগিরা জানিয়েছেন, তারা ৩ দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। – ছবি : নয়া দিগন্ত

দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের বন্যা। বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট থেকে সহসা নামছে না বানের পানি। বৃষ্টি হলে পানি বাড়ে। পানিবন্দী অবস্থায় ২০ দিন পার হলেও দুর্গতদের ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না। জেলার চারটি উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১১টি ইউনিয়নের ৪৪ হাজার পরিবারে নেই ঈদের আমেজ।

পানি উন্নয়ন বিভাগ ও প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, রের্কড পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জুড়ি উপজেলার কন্টিনালা ও কুশিয়ারা নদী হয়ে হাকালুকি হাওরে পানি প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাত বন্ধ না হলে এখানকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। যার ফলে কুশিয়ারা নদীপাড় ও হাকালুকি হাওর এলাকার গ্রামের পর গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।

বন্যা আক্রান্ত এলাকার ভুক্তভোগিরা জানিয়েছেন, তারা ৩ দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যার কারণে আসন্ন ঈদুল আজহার আমেজ নেই বানভাসি মানুষের মধ্যে। গত বোরো মৌসুমে দীর্ঘমেয়াদী খরায় জেলার হাওরগুলোতে কৃষকের রোপণকৃত ব্রি-২৮ জাতের ধানে চিটা ধরায় যেমন লোকসানে পড়েছিলেন হাওরপাড়ের প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষিরা। তেমনি বোরো উত্তোলনের সময় টানা বৃষ্টির কারণে ধান নায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেননি তারা। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ি ও রাজনগর উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৪ হাজার পরিবারের মানুষ। এখন বন্যায় তাদের দুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, হাওর অঞ্চলের ৮০ ভাগ ঘরে এখনো পানি রয়েছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে আবার কেউ কেউ ঘরে পানির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। কোনো কোনো পরিবার উজান এলাকায় স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রামীণ যাতায়াতের রাস্তাগুলো এখনো পানির নিচে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ ও মন্দির তলিয়ে গেছে। প্রতিটি হাটবাজার এখনো পানির নিচে। মানুষের চলাচলের কোনো জায়গা নেই। এছাড়াও বানভাসি মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত ডায়রিয়া, চর্মরোগ, জ্বর, চোখের ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওর পাড়ের মৌসুমি খামারীরা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে আনন্দের চেয়ে দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়েছে ঈদ।

এলাকায় গেলে কথা হয় একাধিক মানুষের সাথে। এ সময় তারা জানান, অভাবের কারণে এবারের ঈদে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই কোরবানি দিতে পারছেন না। আবার কারো কাছে হাত পাততেও পারছেন না।

অন্যদিকে পানিবন্দী এলাকায় কাজ না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন দিনমজুররা। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন জেলার নিন্মাঞ্চলের বানবাসি মানুষগুলো।

কুলাউড়া উপজেলার মুক্তাদির পুর গ্রামের বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে এবার আমাদের ঈদের কোনো আনন্দ নেই। স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কেনা তো দূরের কথা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও জোগানো সম্ভব হচ্ছে না।

মুক্তাদিরপুর গ্রামের রুফিয়া বেগম বলেন, ‘ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ২০ দিন ধরে পানিবন্দী আছি। ঘরের চুলা ডুবে গেছে। ইট দিয়ে রান্নার কাজ চালাই। লাকড়ির অভাবে সব সময় চুলা জ্বলে না। ঈদ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’

কথা হয় হাওরপাড়ের মুক্তাদির পুর ও আলীনগরের প্রান্তিক ও বর্গাচাষী আলকাছ মিয়া, রিপন মিয়ার সাথে। তারা বলেন, আমাদের মাঝে এবছর ঈদের কোনো আনন্দ নেই। আমরা এ বছর ত্রিমুখি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছি। আমাদের একমাত্র সম্বল বোরো ধান। এ বছর বৃষ্টি থাকার কারণে ধান শুকাতে না পারায় কাঁচা ধান পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

তারা জানান, বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো সরকারি ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়নি।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার অর্ণব মালাকার বলেন, ‘বাজেটের শেষ পর্যায়ে তেমন ত্রাণ বরাদ্দ হয়নি। তবে নতুন করে বরাদ্দ আসছে। নতুন বরাদ্দ এলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে তা বিতরণ করা হবে।’

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বন্যা দীর্ঘস্থায়ী বলা যাচ্ছে না। পানি ধীরে নামছে এটা সঠিক। উজানে বৃষ্টি হলে পানি বৃদ্ধি পায়। ভারতের চেরাপুঞ্জিসহ উজানে চলতি বছর ১২২ বছরের রের্কড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি আপ হয়ে আছে। এ নদীগুলোর পানি ডাউন না হলে মৌলভীবাজারের হাওর এলাকার বানের পানি সহসা নামবে না।’