দিল্লি গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ভারতের বিদেশমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের আমন্ত্রণে নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিদেশে এটাই তার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত প্রতিবেশী ভারতে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। সফরটি এমন সময় হচ্ছে যখন বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। যদিও ভারতের সমর্থনে সরকারের ধারাবাহিকতায় স্বস্তিতে টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ কতোটা হবে তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে। মন্ত্রীর সফরটি কেমন হবে? তা নিয়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লির সংবাদমাধ্যমেও কৌতূহলোদ্দীপক নানা বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে। যদিও ঢাকা ও নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্র রাতে মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে দাবি করেছে ৭ই ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আজকে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়া মন্ত্রীর সফরের অনেক কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দ্বিপক্ষীয় প্রথম সফরে সাধারণত সরকার প্রধানের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে গুড উইল ভিজিটে আসা দিল্লির বিদেশ সচিবরাও সরকার প্রধানের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।
এটা অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের তরফে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চাওয়া হয়েছে এমনটা দাবি করে কর্মকর্তারা বলেছেন, কর্মসূচির অনেক কিছু এখনো চূড়ান্ত হয়নি বিধায় ঢাকা আশা করে সফরের সমাপনী দিনে হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপয়েনমেন্ট হবে। গত ১১ই জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাছান মাহমুদকে অভিনন্দন জানান দিল্লির বিদেশমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণও জানান। পরবর্তীতে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিদেশমন্ত্রীর আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন। তখনই ড. হাছান মাহমুদ ঘোষণা দেন যে তিনি প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যাবেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর একটি বহুপক্ষীয় আয়োজনে অংশ নিতে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) এর শীর্ষ সম্মেলন ছিল সেখানে। ওই আয়োজনে ভারতের বিদেশমন্ত্রীও অংশ নেন। ন্যাম সম্মেলনের সাইড লাইনে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বৈঠক হয়। ২০শে জানুয়ারির প্রথম সাক্ষাতে দুই মন্ত্রী পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। ড. হাছান মাহমুদকে অভিনন্দন জানিয়ে সেদিন জয়শঙ্কর বলেন, শিগগিরই দিল্লিতে আপনাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় রয়েছি। বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বাঙ্গীন সাফল্যও কামনা করেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। এদিকে হাছান মাহমুদের সফর বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে সামনে আরও জোরদার করা এবং ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে কৌশলগত পরিকল্পনা ঠিক করা এই সফরের প্রধান লক্ষ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সফরকালে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও নয়াদিল্লিতে একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কে বক্তৃতা দেবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংযোগের ব্যাপারে ভারত-বাংলাদেশ যে কাজ করেছে তা নিয়ে আলোচনা হবে সফরে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সহযোগিতার পরিকল্পনা নিয়েও কথা হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম নীতি’ এবং ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ জোরদার করার লক্ষ্যে নয়াদিল্লির ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের তাৎপর্যের ওপর জোর দেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে ‘৩৬০ ডিগ্রি অংশীদারিত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কানেক্টিভিটি এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে এর ব্যাপক প্রভাবের প্রশংসা করেন ড. এস জয়শঙ্কর। গত ৩০শে জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট মুম্বই শাখা আয়োজিত আলোচনায় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ, তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে যেতে এবং বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। আসল কথা হলো, ভারত এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাস ও ট্রেনের মধ্যদিয়ে যোগাযোগের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। ওদিকে আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, চীন বা অন্য কোনো দেশের আগে প্রথম সফরে বিদেশমন্ত্রীকে নয়াদিল্লিতে পাঠিয়ে হাসিনা সরকার এই বার্তা দিতে চাইছে যে, প্রতিবেশী বলয়ে ভারতই তাদের অগ্রাধিকার। রিপোর্টে বলা হয়, প্রাক্তন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে নয়াদিল্লি ও কলকাতার যোগাযোগ ভালোই।
দিল্লি সফরে মিয়ানমার পরিস্থিতি তুলবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে মন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, ভারত সফরে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি। মঙ্গলবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। সফরে মিয়ানমার পরিস্থিতি তোলা হবে কিনা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতে গিয়ে আমার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আমরা সার্বিক বিষয়গুলো আলোচনা করবো, যেহেতু মিয়ানমার ভারতেরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র, আবার আমাদেরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। এরইমধ্যে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে যাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা আমরা বহু আগে থেকেই চেয়ে আসছি। সুতরাং বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই আলোচিত হবে।
manabzamin