দিল্লির ‘মন’ বুঝে এগোবে ঢাকা

দিল্লির ‘মন’ বুঝে এগোবে ঢাকা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে বড় ধাক্কা লেগেছে। সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ কার্যত বন্ধ। সীমান্ত সমস্যা, নদীর পানিবণ্টনসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় ঝুলে গেছে। আমদানি-রপ্তানিও বিঘ্নিত। দোষারোপে চড়ছে উত্তেজনা। এরই মধ্যে সংখ্যালঘু ইস্যু সামনে এনে ভারত সরকার, দেশটির গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমন্বিতভাবে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারে নেমেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিকৃত, মিথ্যা ও ভুল তথ্য এবং গুজব ছড়াচ্ছে। তবে জবাবে বাংলাদেশ খুবই সতর্ক।

কূটনৈতিক সূত্রের ভাষ্য, এ অবস্থানের মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বার্তা দিলেও, দিল্লির আন্তরিকতা বুঝতে চাইছে ঢাকা এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। এর পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে ফোনে অভিনন্দন জানান। কিন্তু এর পরের প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ককে বলা চলে ‘সাপে-নেউলে’। এ সম্পর্কের পেছনে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, শেখ হাসিনার পতন কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না বিজেপি সরকার। কিন্তু দিল্লির হাতে খেলার মতো খুব বেশি কার্ড না থাকায় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশকে আঘাত করার ন্যূনতম সুযোগও হাতছাড়া করছে না। কিন্তু ভারতের প্রপাগান্ডার বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বের সামনে সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারছে না। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ঢাকা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।

ভারত সরকার ও তাদের গণমাধ্যমের ভূমিকার জবাবে ড. ইউনূস সরকারের তিনটি দুর্বলতা চিহ্নিত করেছেন সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা। তারা করণীয় সম্পর্কেও বলেছেন। প্রথমত, ভারত কোনো বিবৃতি দিলেই কেবল নড়েচড়ে বসছে ঢাকা। অথচ এসব ক্ষেত্রে আগেভাগে বাংলাদেশকে সক্রিয় হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সব অপপ্রচার নিয়ে বাংলাদেশ মাথা ঘামাচ্ছে না। প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে বাছাই করে। তৃতীয়ত, ঢাকা থেকে প্রচার বিবৃতির ভাষা খুবই নমনীয়। অথচ যথাযথ ভাষা প্রয়োগ খুবই জরুরি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ভারতের বর্তমান আচরণে মনে হচ্ছে, ২০০৯ সাল থেকে ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘু ছিল না। আওয়ামী লীগ আমলে প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে। সে সময় ভারত নীরব থেকেছে। হাসিনা সরকারের সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযোগ বিষয়েও কিছু বলতে শোনা যায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও, ভারত শুধু হাসিনার কারণে চুপ

থেকেছে। এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে আক্রান্ত হলেও, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা খুঁজছে ভারত। এর অর্থ, সংখ্যালঘুদের নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রাজনৈতিক। এমন প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই দেশের মধ্যকার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক ফরেন অফিস কনসালটেশনের (এফওসি) আয়োজন চলছে। নিয়মিত স্বাভাবিক সম্পর্ক চালিয়ে নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতের আন্তরিকতা কতটুকু, তা বুঝতে চাইছে ঢাকা। অবশ্য এফওসিতে হাসিনা ইস্যুতে আলোচনার কোনো প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত নেয়নি বাংলাদেশ। কারণ তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইছে না। এ জন্য সম্প্রতি এফওসি কেন্দ্র করে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে হাসিনার প্রসঙ্গ তোলাই হয়নি। তবে শীর্ষপর্যায় থেকে নির্দেশনা এলে, এ ইস্যুতে অগ্রসর হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র তৌফিক হাসান বলেছেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কোনো তথ্য দেয়নি। বাংলাদেশও কিছু জানতে চায়নি।

জানা যায়, এফওসিতে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার দেবে, তা সাজাচ্ছে ঢাকা। তবে দিল্লির অগ্রাধিকার দুটি বিষয়ে। দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে নিরাপত্তা উপভোগ করত, তা নিশ্চিত করতে চাইবে। ড. ইউনূস সরকারের ওপর এ বিষয়ে আস্থা রাখতে পারছে না তারা। এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ রয়েছে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ তুলে ধরবে এফওসিতে।

অহেতুক উত্তেজনা এড়িয়ে প্রত্যাশিতভাবে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। সমকালকে তিনি বলেন, বাস্তবিকতার দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। বাংলাদেশে যে পরিবর্তন হয়েছে, তা ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করলেও, আচরণে তা দেখা যাচ্ছে না। পরিবর্তনকে দিল্লির দিক থেকে উপলব্ধি করা খুবই জরুরি। তিনি বলেন, ভারতের থেকে যা হচ্ছে, তা মানুষের মধ্যে তিক্ততা তৈরি করছে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ঘাটতি দূর করা এবং সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার সুযোগ এফওসিতে রয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তুতির মধ্যেই একের পর এক অপপ্রচার ও আঘাত হচ্ছে। কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনের বাইরে ‘বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন সহিংস বিক্ষোভ করেছে, যা দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশিদের এমনিতেই ভিসা সীমিত করেছে ভারত। এখন উত্তর কলকাতার জেএন রায় হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক চিকিৎসক বাংলাদেশি রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন।

ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ভারতের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ অবদান রেখে আসছে। এসব ভুলে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের অযাচিত, শিষ্টাচারবহির্ভূত ও অকূটনৈতিকসুলভ মন্তব্যকে শিশুতোষ রাজনীতিই বলা শ্রেয়। বাংলাদেশকে যৌক্তিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের জবাব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সরকার ও রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে, নমনীয়তার পরিবর্তে তা আরও যথাযথ হওয়া দরকার।

কূটনীতিকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন বাংলাদেশকে কিছু বলে, তখন তা শুনতে হয়। কারণ, বাংলাদেশের আয়ের সিংহভাগ আসে পশ্চিমা দেশ থেকে। কিন্তু এটাও ঠিক, ভারতীয় অর্থনীতির অন্যতম বড় উৎস বাংলাদেশ। পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ১ হাজার কোটি ডলার আয় করে। বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ বাংলাদেশি দেশটিতে চিকিৎসা, পর্যটন ও ব্যবসায়িক কাজে যান। এখান থেকে কয়েকশ কোটি ডলার আয় করে ভারত। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বহু ভারতীয় কাজ করে দেশটির রেমিট্যান্স শক্ত করছেন। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক শক্তি, তা ভারতকে অবশ্যই দেখানো দরকার।

সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া উপলব্ধি করবে ভারত : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক রকম ছিল, পরে সেটি পরিবর্তন হয়েছে। এটাই হলো বাস্তবতা। বাস্তবতার নিরিখেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিনির্মাণ করতে হবে। আমার বিশ্বাস, ভারত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নিতে হবে, তা উপলব্ধি করবে। হয়তো ইতোমধ্যে করছেও এবং সে অনুযায়ী এগোবে প্রত্যাশা করি।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের যেসব উদ্বেগ ছিল, সেগুলো দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা তারা করেছে। আমাদেরও কিছু উদ্বেগ ছিল, আছে। যদি একই সঙ্গে আমাদের উদ্বেগগুলো ঠিকমতো দূর করা হতো, তাহলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে যে দোলাচল, তা থাকত না। মোটাদাগে দেখতে পাই, আমাদের যেগুলো উদ্বেগ ছিল, সেগুলোতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ভারত। আর এ কারণেই সম্পর্ক এ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সামনে যেসব প্রতিবন্ধকতা, তা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। যেমন, পানি সমস্যা। এটা নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমরা চাইব, অগ্রগতি হোক। সীমান্ত হত্যা, তারা যা করছে, এটা অগ্রহণযোগ্য। এটাই পৃথিবীর একমাত্র সীমান্ত, যেখানে যুদ্ধাবস্থা না থাকলেও মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছে। এটি একটা শক্ত প্রতিবন্ধকতা এবং ভারতকেই তা দূর করতে হবে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক: প্রত্যাশা, প্রতিবন্ধকতা এবং ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। তাতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ভারতীয় মিডিয়া হঠাৎ ভয়ংকরভাবে আমাদের ওপর লেগে পড়ল। আমি স্পষ্টভাবে ও খোলাখুলিভাবে বলেছি। এমনকি আমরা বিভিন্নভাবে বিবৃতিও দিয়েছি। তারা যে ভূমিকা নিয়েছে, তা কোনোভাবেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সহায়ক নয়। এটি কেন করছে, তারাই ভালো বলতে পারবে। এখানে আমার মনে হয়, আমাদের মিডিয়ার ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। ভারতের মিডিয়া যে মিথ্যাচার করছে, তা তুলে নিয়ে আসা। ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে তাদের বক্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা। এসব বিষয়ের সত্য তুলে ধরা এবং আমাদের মিডিয়ার কভারেজ আরেকটু হওয়া উচিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যখন কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়, তা প্রথম পেজেই আসা উচিত, ভেতরের পাতায় নয়।

বাংলাদেশ নিয়ে বেশি কথা বলা ঠিক হবে না : শশী থারুর
বাংলাদেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনায় ভারতের বেশি কথা বলা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস নেতা ও সংসদ সদস্য শশী থারুর। ভারতের সংবাদমাধ্যম এএনআইকে তিনি বলেন, আমাদের এটি নিয়ে খুব বেশি কথা বলা ঠিক হবে না। আমাদের দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এটি। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে শশী বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ১১ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি একটি বৈঠক ডেকেছে।’ এ কমিটির বর্তমান প্রধান শশী থারুর। তিনি আরও বলেন, যদি এ বিষয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু বলার থাকে, তাহলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টে এসে বললে ভালো হয়। বাংলাদেশে যা ঘটছে, আমরা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সব সংখ্যালঘুর নিজ দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়া উচিত।

samakal