দাম বাড়ালেও গ্যাস কমিয়ে দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে!

ইসমাইল আলী: গত ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি করা হয়। বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ ও বাণিজ্যিক খাতে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও আবাসিক, সার, চা বাগান ও সিএনজি খাতকে ছাড় দেয়া হয়। সে সময় বলা হয়েছিল, গ্যাসের বর্ধিত দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো হবে। বাড়তি সে গ্যাস সরবরাহ করা হবে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে। যদিও বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টোটা।

গত অর্থবছর এলএনজি আমদানি না বেড়ে উল্টো কমে গেছে। এতে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহও কমেছে। এছাড়া গত অর্থবছর দেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনও ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সব মিলিয়ে গত অর্থবছর জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমেছে। এতে বাড়তি দাম দিয়েও কম গ্যাস পেয়েছে বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ ও বাণিজ্যিক খাত।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, গত অর্থবছর এলএনজি আমদানি করা হয়েছে চার দশমিক ০৮৪ মিলিয়ন টন, ২০২১-২২ অর্থবছর যার পরিমাণ ছিল পাঁচ দশমিক ০৬২ মিলিয়ন টন। আর গত অর্থবছর জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৪৫ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৮০৯ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ গত অর্থবছর এলএনজি আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৩২ শতাংশ ও সরবরাহ কমেছে ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৫ দশমিক ৬১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের (২০২১-২২) অর্থবছর গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৮৩ দশমিক ১০৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ গত অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন কমেছে এক হাজার ১৩৭ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ঘনমিটার বা চার দশমিক ৭৮ শতাংশ। ফলে সার্বিকভাবে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে।

গত অর্থবছর সব খাত মিলিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস সরবরাহ করে ২৬ হাজার ৪০২ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের অর্থবছর গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৩৫৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ গ্যাস সরবরাহ কমেছে প্রায় সাত শতাংশ, যার প্রভাব পড়েছে প্রায় সবগুলো খাতেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে আবাসিক খাতে। গত অর্থবছর এ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ। যদিও এ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে সিএনজি খাতে ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে দাম বৃদ্ধির পরও ক্যাপটিভে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় চার হাজার ৯৭৫ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল চার হাজার ৬৫২ দশমিক ২৮৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ ক্যাপটিভে গত অর্থবছর গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে ছয় দশমিক ৯৫ শতাংশ। অথচ ক্যাপটিভে গত ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়, আগে যা ছিল ১৪ টাকা।

অনেকটা একই চিত্র শিল্প খাতে সরবরাহকৃত গ্যাসে। গত অর্থবছর এ খাতে গ্যাস দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৪০৯ দশমিক ০৭৮ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের অর্থবছর শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৬১ দশমিক ৭৭৫ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমেছে ছয় দশমিক ৮৬ শতাংশ। অথচ শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বৃহৎ শিল্পে গ্যাসের দাম ছিল প্রতি ঘনমিটার ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবং কুটির শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা। তবে ফেব্রুয়ারিতে সব ধরনের শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম করা হয় প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা।

অন্যদিকে বিদ্যুতে গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে এ খাতে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার পাঁচ টাকা দুই পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাস তিন দশমিক ২২ শতাংশ কমানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে গ্যাস দেয়া হয় ১১ হাজার ২৭ দশমিক ৩৫১ মিলিয়ন ঘনমিটার। ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৩৮২ দশমিক ৮১৯ মিলিয়ন ঘনমিটার।

যদিও গত ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম সবচেয়ে কম বাড়ানো হয়। ওই সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল চার দশমিক ২৩ শতাংশ। ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা ঘনমিটারপ্রতি গ্যাস এ খাতে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে গত অর্থবছর বাণিজ্যিক খাতে গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে দুই দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর বাইরে চা বাগানে সরবরাহকৃত গ্যাস গত অর্থবছর কমানো হয়েছে তিন দশমিক ৫৪ শতাংশ।

সার কারখানাতেও গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে গত অর্থবছর। এ খাতে ১৭ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে। সূত্রমতে, বর্তমানে সার কারখানাগুলোয় গ্যাসের সর্বোচ্চ চাহিদা রয়েছে দৈনিক ৩২৯ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সরবরাহ করা হচ্ছে ১৩৫-১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে গ্যাস সংকটে পুরোনো কারখানাগুলো প্রায়ই বসে থাকছে। এরপরও চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ সার কারখানা উদ্বোধন করা হয়েছে। তবে গ্যাস সংকটে এটিও পুরোদমে চালানো যাবে না বলেই শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।