দাম বাড়ানো ছাড়া নতুন উদ্যোগ নেই বিদ্যুতে

দাম বাড়ানো ছাড়া নতুন উদ্যোগ নেই বিদ্যুতে

বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার অভাবে বিদ্যুতে লোকসান বাড়ছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ায় সরকারকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে মূলত ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা বলে এলেও  সরকার নতুন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। দাম বাড়িয়েই এই লোকসান কমাতে চাচ্ছে। আগামী তিন বছরে ৭১ শতাংশ দাম বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতে প্রতিবার ৫ শতাংশ হারে বছরে চারবার দাম বাড়বে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুসারে বিদ্যুতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই যুক্তি দেখিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সংস্কার না করে সরকার দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি
তথা লোকসান সামলানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গত ফেব্রুয়ারিতে গড়ে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছর তিন দফায় দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। এ ছাড়া এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝোঁক এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। খরচ বাড়ার মূল কারণ, ভুল নীতি।

খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির দাম পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। দিন দিন বাড়ছে বকেয়া। এ বছর গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদর্শ মান অনুসারে চাহিদার ২০ শতাংশ রিজার্ভ মার্জিন রাখা হয়। এ বিবেচনায়  এই মুহূর্তে রিজার্ভ মার্জিনসহ উৎপাদন সক্ষমতা থাকা দরকার ২১ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অতিরিক্ত সক্ষমতা রয়েছে ৬ হাজার মেগাওয়াট। রিজার্ভ মার্জিন ৩৪ শতাংশের বেশি। উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকার কারণে সরকারকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে, যে চার্জ অলস বসে থাকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। গত ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি  বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এতে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়। বেড়েছে পিডিবির লোকসান। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা বিদ্যুৎ, কয়লা ও গ্যাস বিল বাবদ পিডিবির কাছে ৪১ হাজার কোটি টাকা পাবে।

দেনা মেটাতে সরকার বন্ড ইস্যু করেছে। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। দায় মেটাতে চলতি অর্থবছর পিডিবি ভর্তুকি চেয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকার বরাদ্দ রেখেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া গত অর্থবছরের ৩০ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি এখনও পিডিবি হাতে পায়নি।

এদিকে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হলেও গ্রামের মানুষ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এর কারণ, ডলার সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ার মূল কারণ ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতা। তিনি বলেন, সরকার পছন্দের ব্যবসায়ীদের বিদ্যুতের ব্যবসা দিয়েছে প্রতিযোগিতা ছাড়াই। এ খাতে কোথায়, কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করছে, তা নিয়ে প্রশ্নও তোলার সুযোগ রাখেনি। আইন করে দায়মুক্তি দিয়েছে। দুর্নীতি কমালে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, গ্রাহক সে হারে বাড়েনি। অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। এ ছাড়া এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝোঁক এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। ফলে ভর্তুকি বাড়ছে। ভর্তুকি সামলাতে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,  অযৌক্তিক ক্যাপাসিটি পেমেন্ট সমন্বয় করা গেলে বিদ্যুতের মূল্য এভাবে বাড়ানোর দরকার হতো না। ভর্তুকিও বাড়ত না।

দাম বাড়বে যেভাবে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুসারে বিদ্যুতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই যুক্তি সামনে রেখে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সংস্কার না করে সরকার দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি তথা লোকসান সামলানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা সফররত আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগ এই পরিকল্পনা তুলে ধরে। ওই পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে ১১ দফায় বিদ্যুতের পাইকারি দাম বর্তমান মূল্য ৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৪ পয়সা করা হবে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, নভেম্বর আর ডিসেম্বরে ৫ শতাংশ হারে দাম বৃদ্ধি পাবে।  গত ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ পাইকারি দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৩৫ পয়সা বেড়ে প্রতি ইউনিটে গড়ে হবে ৭ টাকা ৩৯ পয়সা। ডিসেম্বরে ৩৭ পয়সা বাড়বে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৯ পয়সা, ফেব্রুয়ারিতে ৪১ পয়সা, নভেম্বরে ৪৩ পয়সা আর ডিসেম্বরে ৪৪ পয়সা বৃদ্ধি পাবে। ২০২৫ সালের শেষে পাইকারি বিদ্যুতের গড় দাম হবে ৯ টাকা ৪৩ পয়সা। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে ৪৮ পয়সা, ফেব্রুয়ারিতে ৪৯ পয়সা, নভেম্বরে ৫২ পয়সা ও ডিসেম্বরে ৫৫ পয়সা বাড়ানো হবে। ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে ৫৭ পয়সা বাড়বে। এতে সেই সময় প্রতি ইউনিটের পাইকারি দাম হবে গড়ে ১২ টাকা ৪ পয়সা। বর্তমানে প্রতি ইউনিটের গড় সরবরাহ মূল্য ১১ টাকা ৯৬ পয়সার কাছাকাছি। ফলে অন্য কোনোভাবে ব্যয় না বাড়লে ২০২৭ সালের জানুয়ারির পর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির কোনো লোকসান হবে না বরং লাভ হবে। পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে সমানুপাতিক হারে খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়বে। বর্তমানে প্রতি ইউনিটের খুচরা মূল্য গড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।

samakal