দল, সরকার, রাষ্ট্র মিলেমিশে একাকার
প্রভাষ আমিন
এটা সবাই করে, তবে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না। আমরা মানুষ তো, চক্ষুলজ্জা বলে একটা বিষয় আছে। কিন্তু বাগমারা থানার ওসি আতাউর রহমান সেটা খুইয়েছেন অনেক আগেই অথবা চক্ষুলজ্জা বলে যে একটা বিষয় আছে, সেটা তিনি জানেনই না। গত বুধবার তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পৌর মিলনায়তনে। কোনও রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে পুলিশ উপস্থিত থাকতেই পারে। তবে সেটা নিরাপত্তাজনিত কারণে। কিন্তু আতাউর রহমান শুধু সম্মেলনে উপস্থিতই ছিলেন না, মঞ্চে উঠেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছে, কাজটা যে ঠিক হয়নি, সেটাও তিনি বুঝতে পারছেন না। মঞ্চে উপস্থিত থাকা ও বক্তৃতা দেওয়া তার কাছে কোনও সমস্যা মনে হয়নি। ফেসবুকে এ নিয়ে সমালোচনা হয়। জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সরকারে তো আওয়ামী লীগই আছে। যদি বিএনপির সভায় উপস্থিত থাকতাম, তাহলে সমালোচনা হতে পারতো।’ কী সরল স্বীকারোক্তি। মনে হচ্ছে তিনি অতি সরল। তবে একজন ওসির একটি রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে উপস্থিত থাকা যে ঠিক নয়, সেটা যিনি না বোঝেন; তাকে ওসির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রাখা ঠিক নয়। আর যদি বুঝে করে থাকেন, তাহলে অতি সত্ত্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আতাউর রহমানের মতো অতি উৎসাহীরাই যুগে যুগে দলকে ডুবিয়েছে, পুলিশ বিভাগকে ডুবিয়েছে।
তবে আতাউরদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। অনেক আগেই আমরা দল, সরকার, রাষ্ট্র গুলিয়ে ফেলেছি—একাকার করে ফেলেছি। অনেক আগে থেকেই অনেক ডিসি-এসপি-ওসিই অলিখিতভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের নির্দেশে বা পরামর্শেই দল চলে। কাগুজে সভাপতিরা ডিসি-এসপির কথার বাইরে যান না। বাইরে যেতে চাইলে ত্যাদড় ডিসি-এসপিরা শুনিয়ে দেন, দলকে তো আমরা ক্ষমতায় এনেছি, আপনারা নন। যে বাহিনী মনে করে, তারাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে, দলীয় সম্মেলনে সে বাহিনীর একজন ওসির বক্তৃতা দেওয়াটা আসলেই অন্যায় নয়। পুরো দেশটাই যেখানে আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে, সেখানে বেচারা ওসির দোষ দিয়ে আর কী হবে?
এভাবেই একের পর এক ভেঙে পড়ে আমাদের সব প্রতিষ্ঠান। সবাই নিজেদের সীমাটা ভুলে যাই। সে কারণেই রাজনীতিবিদের কাজ করে পুলিশ, পুলিশের কাজ করে ছাত্রলীগ। এখন যেখানে দল, সরকার, রাষ্ট্র মিলেমিশে একাকার, সেখানে সাংগঠনিক কাজে আরও বেশি সময় দিতে ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট্র সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এই সংমিশ্রণ প্রক্রিয়ায় সরকার আর রাষ্ট্রও এক হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের বিরোধিতা করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর সরকারের বিরোধিতা গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ইদানীং বাংলাদেশে সরকারের বিরোধিতাকেই রাষ্ট্রবিরোধিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই রাষ্ট্রবিরোধিতার মামলা হয়। অথচ একসময় এই বাংলাদেশেই রাজনৈতিক বিরোধিতার চমৎকার সব শৈল্পিক নিদর্শন ছিল। এক শিশির ভট্টাচার্য শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া আর এরশাদের কত কার্টুন করেছেন; তার কোনও ইয়ত্তা নেই। তখন রাজনীতিবিদদেরও বিরোধিতা সহ্য করার মানসিকতা ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুনের সংস্কৃতিটাই হারিয়ে গেছে। শিশির ভট্টাচার্যের ঘাড়ে কয়টা মাথা, তিনি শেখ হাসিনাকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন আঁকবেন! শেখ হাসিনার সাধারণ রাজনৈতিকবিরোধিতা করে কিছু লিখলেও তার বিরুদ্ধে কটূক্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে অতি উৎসাহী কেউ না কেউ মামলা করে দেন। আর আতাউর রহমানের মতো অতি উৎসাহী আওয়ামী পুলিশ সদস্যরা অভিযুক্তকে ধরে নিয়ে যায়। এভাবেই বাংলাদেশজুড়ে বিরোধিতার সংস্কৃতিকে ধামাচাপা দিয়ে ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানো হয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা নিজে সবসময় বিরোধিতাকে স্বাগত জানান। কিন্তু বাংলাদেশে এখন দা’য়ের চেয়ে আছাড় বড়।
মাসিদের সংখ্যাই বেশি, তাদের দরদও বেশি। বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগারের সংখ্যা অনেক বেশি। আশার কথা হলো—এই অতি উৎসাহী হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে শুনছি। তবে, অভিযানটা শুধু দলে নয়, প্রশাসনের সর্বস্তরে হতে হবে। অতি উৎসাহীদের সীমাটা বুঝিয়ে দিতে হবে। আমরা যেন কোনোভাবেই নিজেদের সীমা লঙ্ঘন না করি। দল, সরকার, রাষ্ট্র—সব আলাদা থাকুক, যার যার দায়িত্ব সে সে পালন করুক।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ