তুলনামূলকভাবে কম কারচুপি হলেও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠ ও অবাধ হয়নি।

তুলনামূলকভাবে কম কারচুপি হলেও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠ ও অবাধ হয়নি।

ভোটার বিহীন নির্বাচন ডেভিড বার্গম্যান February 7, 2020

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন একজন ভোটার। ফটো : আবু সুফিয়ান জুয়েল /প্যাসিফিক প্রেস /আলামি লাইভ নিউজ

বিরোধীদলের কোন নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়নি, নির্বাচনের প্রাক্কালে গণআটক হোননি বিএনপির পোলিং এজেন্টরা, নির্বাচনের আগের রাত্রে ব্যালট বাক্সে ভোট ভরে রাখার মতো ঘটনাও ঘটেনি। সেই বিচারে ঢাকার যে দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা জয় লাভ করলেন তা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গত ১১ বছরের সকল নির্বাচনের মধ্যে মোটামুটি সুষ্ঠ হয়েছে বলা যায়।

সিটি নির্বাচনের এই আপাত বৈশিষ্ট্যই পুরো নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র নয়। সরকারদলীয় কর্মীরা অনেক ভোটকেন্দ্রেই বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট ও কর্মীদের বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখল করে রেখেছিলেন। যেসকল ভোটার ভোট দিতে গিয়েছিলেন, তারাও একধরণের চাপের মধ্যে পড়েছিলেন, এমনকি পোলিং বুথের ভিতরেও তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য। প্রিসাইডিং ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হাতে ইভিএম মেশিন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সব মিলিয়ে এই নির্বাচন সুষ্ঠ ও অবাধ হয়েছে এমনটি বলা যাবেনা।

সিটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ৩০ শতাংশেরও কম, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই নির্বাচনে আগেরমতো ব্যাপক কারচুপি হয়নি। যদি ব্যাপক ভোট ডাকাতি হতো তাহলে প্রদত্ত ভোটের হারও অনেক বেশি দেখানো হতো। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে যেমন সারাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মীরা এমন ভাবে ব্যালট বাক্সে ভোট ভরে রেখেছিলেন যে প্রদত্ত ভোটের হার ৮০ শতাংশের উপরে গিয়েছিলো।

তবে সরকার সিটি নির্বাচনেও কারচুপির পরিকল্পনা করছিলো এমনটিও শোনা যাচ্ছিলো। আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি সিটি নির্বাচনে আশাতীতভাবে ভালো করবে এমন একটি সতর্কবাণী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলো। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হাতে ইভিএম মেশিন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অধিকতর ক্ষমতা দেওয়ারও প্রস্তাব ছিলো। যদিও এই প্রস্তাবটি পরে নাকচ হয়ে যায়।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সিটি নির্বাচনে বেশ বড় একটি হস্তক্ষেপ করেছেন।

সিটি নির্বাচনের ঠিক এক দিন আগে, ৩০শে জানুয়ারি, নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশসহ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে কমিশন ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত সর্বমোট ৭৪ জন ব্যক্তিকে (যাদের মধ্যে বিদেশী ৪৬ জন, বাংলাদেশী ২৮ জন) নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। চিঠিতে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

এই নির্দেশনায় বিতর্কিত কিছুই ছিল না। সর্বশেষ জাতীয় ও পূর্বের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ পূর্ববর্তী সকল নির্বাচনেই পর্যবেক্ষক হিসাবে স্থানীয় কর্মীদেরসহ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দূতাবাসের স্থানীয় কর্মীদের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ বেশিরভাগ কূটনীতিকরা বাংলা বলেন না।

কিন্তু নির্বাচনের আগের দিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সকল দূতাবাসকে একটি নোট প্রেরণ করে বলে: “মন্ত্রনালয় জানতে পেরেছে যে কিছু দূতাবাস ভোটের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দেখার জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দল গঠন করছে। এই প্রসঙ্গে মন্ত্রনালয় উল্লেখ করতে চায় যে ‘বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষক ২০১৮ এর নীতিমালা’ অনুসারে দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশি জাতীয়তার কোন ব্যাক্তি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে নির্বাচন পর্যবেক্ষনের যোগ্য নন।” নোটে অনুরোধ করা হয় যেন দূতাবাস গুলো তাদের বাংলাদেশি কর্মকর্তা দের কে নির্বাচন পর্যবেক্ষকের দলে অন্তর্ভুক্ত না করে।

নির্বাচনের দিন ভোরে প্রধানমন্ত্রী বিদেশী দূতাবাসদের নিয়ম ভঙ্গের ব্যাপারে তার বক্তব্য দেন, “নির্বাচন কমিশন কি ভাবে এটি মেনে নিতে পারে? আচরণবিধি সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে বিদেশী পর্যবেক্ষকরা বিদেশী নাগরিক হওয়া উচিত। তারা এটি সঠিকভাবে করেনি।”

এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে যে এই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয়ের দাবীই ভুল। ২০১৮ এর নিতিমালা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটেই আছে এবং যে কেউ যাচাই করে দেখতে পারেন যে এই নীতিমালায় দূতাবাসের বাংলাদেশী কর্মকতাদের বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলাই হয়নি, তাদের পর্যবেক্ষক হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাতো পরের ব্যাপার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষেত্রে হ্বস্তক্ষেপ ছিলো নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় এক অনভিপ্রেত আঘাতের সামিল, যার ফলে অন্তত ২৮ জন অনুমোদিত পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষনে অংশ নিতে পারেননি।

নির্বাচনের দিন সকালে বিদেশী দূতাবাসগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশীদের নিয়ে প্রশ্ন তুলে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “ওই সব মিশনে অনেক বৈরী মানুষ কাজ করছেন। আমি তাদেরকে চিনি। এদের কারো বাবা ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন আবার এদের মধ্যে অনেকের বাবা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন। এদের মধ্যেই কেউ কেউ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও মা-বোনের সম্ভ্রমহানী এবং এইসব জঘন্য কাজে পাকিস্তানীদের দোসরদের সহযোগিতা করেন। তারা স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তরসূরী। মিশন তাদের নামই বিদেশী পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছে।”

এসব নিতান্তই ভিত্তিহীন অভিযোগ যার পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। তবে আওয়ামী লীগের শত্রু হিসাবে বা বাংলাদেশের শত্রু হিসাবে কাউকে সংজ্ঞায়িত করাটা আওয়ামী লীগের এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী কৌশল যা তারা ব্যবহার করে যখনই কোন মত তাদের বিরুদ্ধে যায় বা যখনই তারা কোন বিষয়ের উপর থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে চায়। দূতাবাসগুলোও এই ধরনের অযৌক্তিক অভিযোগের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য দেয়নি যা কিনা তাদের এক ধরনের চারিত্রিক দুর্বলতারই লক্ষণ।

সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে বিএনপির করুন অবস্থাও বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। ভোট প্রদানের স্বল্প হার থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে দলটির সমর্থক আর শুভানুধ্যায়ীরা ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহী ছিলেননা। এর কারণ হতে পারে যে তারা সরকারের বিকল্প হিসেবে বিএনপির উপর ভরসা করতে পারেননি অথবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপরেই তাদের আর কোন আস্থা নেই। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী কারচুপিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর জনগণের এখন আর কোন আস্থাই নেই, ভোট দিতে এখন আর কেউ আগ্রহীও নয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে তুলনামূলকভাবে কম কারচুপি হওয়া এই নির্বাচনে বিএনপির সমর্থকরা যদি দল বেঁধে ভোট দিতে যেতেন তাহলে হয়তো তারাই জিততেন।●

ডেভিড বার্গম্যান নেত্র নিউজের ইংরেজী বিভাগের সম্পাদক।