তুরাগপাড়ে নতুন প্রকল্প: কৃষক-জেলেদের উচ্ছেদ করে উচ্চবিত্তের আবাসন গড়বে রাজউক

bonikbarta.net

আল ফাতাহ মামুন

এপ্রিল ০৭, ২০২৩

জেলে, কৃষকসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে তুরাগ নদ ঘিরে ছবি: আরডিআরসি

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী নদী থেকে উত্পন্ন হয়ে রাজধানীর সীমান্ত দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে তুরাগ নদ। মাঝে ঢাকার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে ভাগ হয়েছে দুটি ধারায়। মূল শাখাটি আমিনবাজার হয়ে পড়েছে বুড়িগঙ্গায়, অন্যটি বিরুলিয়া থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে বালু নদে গিয়ে মিশেছে। ঢাকার একাংশকে ঘিরে রাখা এ নদ অনেক আগে থেকেই দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। শিল্প ও পৌর বর্জ্য কিংবা কচুরিপানার জটলায় নৌ যোগাযোগও প্রায় অচল। শত বছর মেয়াদি সীমানা পিলার গেড়েও দখল থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ এ নদ। এবার তুরাগতীরে উচ্চবিত্তের জন্য আবাস গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। যদিও সংস্থাটির দাবি, আশুলিয়া ও তুরাগের বন্যাপ্রবাহ এলাকা রক্ষা করাই এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, চলমান ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) আশুলিয়ার বড় অংশকে বন্যাপ্রবাহ এলাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়তই এলাকাটি ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে নানা অবকাঠামো। ভরাট হচ্ছে তুরাগ নদও। তাই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়ই একটি কমপ্যাক্ট টাউনশিপের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজউক। প্রকল্পের মাধ্যমে আশুলিয়া ও তুরাগের বন্যাপ্রবাহ এলাকা রক্ষাসহ অতি উচ্চবিত্তের জন্য নির্মাণ করা হবে আবাসন। তবে এর জন্য অন্তত ১৩টি জেলেপল্লী, স্থানীয় কৃষক, মাঝি ও নদীকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করা মানুষদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করতে হবে।

উচ্চবিত্তের আবাসনের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ এবং জীবিকার ক্ষেত্র তাদের বিল ও নদী থেকে বঞ্চিত করার কঠোর সমালোচনা করেছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, নদীতীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা সংকুচিত করে নদী রক্ষার নামে উচ্চবিত্তের জন্য আবাসন গড়ার কোনো অধিকার রাজউকের নেই। রাজউক যদিও বলছে, আশুলিয়া থেকে তুরাগ পর্যন্ত প্রায় নয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এতে দুই হাজার একরে থাকবে আবাসন, ছয় হাজার একরের বেশি থাকবে বন্যাপ্রবাহ এলাকা ও কৃষিজমি। অর্থাৎ স্থানীয় জেলে-ষকদের জন্য আবাসন ও জীবিকার ব্যবস্থা রেখেই এ প্রকল্পের কাজ করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তুরাগ-আশুলিয়ার বন্যাপ্রবাহ এলাকা প্রতিনিয়তই ভরাট করছে ভূমিদস্যুরা।

ফলে মেগাসিটির প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে। এর প্রতিকারের জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিতে বলেছেন। একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে রাজউক সে অনুযায়ী একটি সমীক্ষা করেছে। সেটা দেখে প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে মোতাবেক ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। বিদেশী বিনিয়োগের জন্যও সোর্স খোঁজা হচ্ছে। বিনিয়োগের ধরনসহ বিস্তারিত পরে জানা যাবে।’

রাজউকের পরিকল্পনাগত প্রভাব বিবেচনা ও তাদের পূর্বাচলসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে এ প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মাদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজউকের মূল কাজ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ হলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের আগ্রহ বেশি।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের এ সংস্থা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। তুরাগ কমপ্যাক্ট টাউনশিপ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ভালো হলেও এর কারণে আশপাশের ভূমি ব্যবহার ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাজউকের নেই। ফলে এ ধরনের প্রকল্প নগরের জন্য নেতিবাচক প্রভাবই নিয়ে আসে। তাছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার বাদ দিয়ে উচ্চবিত্তের আবাসন নির্মাণের লক্ষ্যকে কোনোভাবেই ভালো পরিকল্পনা বলা যায় না।

এ ধরনের প্রকল্প আমাদের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চাভিলাষী ও ব্যয়বহুলও বটে।’

উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ রাজউকের মূল কাজ জানিয়ে এ পরিকল্পনাবিদ আরো বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, রাজউকের মূল কাজ কখনই আবাসন ব্যবসা নয়। তাদের কাজ হলো উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ। অথচ সে কাজটা করতে তারা ব্যর্থতার পরিচয় কেন দিচ্ছে সেটার তথ্যানুসন্ধান জরুরি। পাশাপাশি নদী ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা রক্ষার জন্য উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও আইনের শাসনের প্রয়োগের পাশাপাশি প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি।’

সূত্র জানায়, সাভারের মোট চারটি ইউনিয়নে কমপ্যাক্ট টাউনশিপ প্রকল্পের কাজ করবে রাজউক। সেগুলো হলো কাউন্দিয়া, বনগ্রাম, বিরুলিয়া ও আশুলিয়া। এ চার ইউনিয়নে অন্তত পাঁচটি বিল রয়েছে। টঙ্গী বিল, আশুলিয়া বিল, বিরুলিয়া বিল, কাউন্দিয়া বিল ও গাবতলী বিল। এসব জলাধারের ওপর নির্ভর করে সেখানকার ১৩টি জেলেপল্লী, কৃষক ও স্থানীয় নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকা।

জেলেপল্লীগুলো হলো আশুলিয়া উত্তর পাড়া, আশুলিয়া দক্ষিণ পাড়া, রুস্তমপুর, বিরুলিয়া, কাউন্দিয়া, ঈশাখাঁবাদ, মেলারটেক, মাঝিরদিয়া, বাগিচারটেক, বারানি, বেলতলি, কটবাড়ি ও বরাদপুর।

তুরাগপাড়ের জেলেদের জীবন ও অধিকার নিয়ে বিভিন্নভাবে কাজ করছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নদীর ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার নদীপাড়ের মানুষের। আর নদীকে ঘিরে যারা বাঁচে তাদের বঞ্চিত করে রাজউক কোনো আবাসন প্রকল্প নিতে পারে না। যদিও রাজউক বলছে, জেলে ও কৃষকদের এখানে বসবাস ও কাজের সুযোগ থাকবে—এটার নিশ্চয়তা কী? একটা সময় দেখা গেল নিরাপত্তার স্বার্থে জেলেদের আর প্রকল্প এলাকায় ঢুকতেই দেয়া হলো না। এমন অনেক কিছুই হতে পারে।

বন্যাপ্রবাহ বা তুরাগ রক্ষার নামে জেলেদের উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা রাজউক করতে পারে না।’

তুরাগ নদ রক্ষায় রাজউক কোনো প্রকল্প নিলে সেখানে স্থানীয় জনগণ উপকৃত হয় এমন উদ্যোগ থাকতে হবে বলে জানান মোহাম্মদ এজাজ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় কৃষক ও জেলেদের জীবন-জীবিকা সংকুচিত না করে বরং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কীভাবে বন্যাপ্রবাহ এলাকা ও তুরাগ নদ সংরক্ষণ করা যায় সে পরিকল্পনা করা জরুরি। আর সেটি করলে আমরা বলব রাজউক একটি ভালো কাজ করতে যাচ্ছে। তাছাড়া বন্যাপ্রবাহ এলাকায় জোয়ার-ভাটার বিষয় আছে। সেখানে যে অবকাঠামো নির্মাণ হবে তাতে জোয়ার-ভাটা বাধাগ্রস্ত হলে পুরো প্রকল্পই ব্যর্থ হবে।

তখন দেখা যাবে, সরকারি উদ্যোগের বাকি জায়গাটুকু ভরাট করে ফেলা হবে। উপকূলীয় এলাকার ক্ষেত্রে এমনটিই দেখেছি আমরা।’

তুরাগ কমপ্যাক্ট টাউনশিপ প্রকল্পে কেবল উচ্চবিত্তই নয়, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্যও আবাসন থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যাপ্রবাহ রক্ষায় এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এখানে ৬২ শতাংশ পানি ও কৃষিভূমির জন্য জায়গা রাখা হবে।

কৃষক ও জেলেদের জন্য আবাসন থাকার পাশাপাশি তারা যেন তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সে বিষয়টিও প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা হবে। এখানে তিন ধরনের আবাসন থাকবে। অতি উচ্চবিত্তদের জন্য আড়াই হাজার বর্গফুটের বেশি অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে। আবার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্যও অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে।’

জলাশয় ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা রক্ষার নামে নতুন প্রকল্প নিয়ে সেখানে আবাসন নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজউক ৬২ শতাংশ জলাভূমি রক্ষার কথা বলছে কেন? সংস্থাটির তো শতভাগ জলাভূমি রক্ষা করার কথা। নদীগুলো ও জলাভূমি ভরাটের প্রক্রিয়া তো এভাবেই শুরু হয়। আমরা জানতে চাই, আশুলিয়া-তুরাগ দখল-দূষণ রোধে রাজউক গত ১০ বছরে কয়টা মামলা করেছে? কী পদক্ষেপ নিয়েছে? নাকি এলাকাটি যেন ভরাটের জন্য উপযুক্ত হয়, সে অপেক্ষায় তারা চুপ ছিল।

আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, ঢাকার বাসযোগ্যতা রক্ষায় আর এক ইঞ্চি জলাভূমি, কৃষিজমি, খাল-বিল ও নদীর জমি ভরাট বা কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ নেই। সদিচ্ছা থাকলে আবাসন না বানিয়েই বন্যাপ্রবাহ এলাকাটি রক্ষা করা সম্ভব।’

প্রকল্পে আবাসন রাখা প্রসঙ্গে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সেখানে বড় বড় খাল খনন করব। ৪০০ ফুট নদী রাখব। তাহলে এ খননের মাটি ফেলব কোথায়? সেজন্যই নয় হাজার একরের মধ্যে মাত্র দুই হাজার একর জমি আবাসনের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা ভাবছি।

তবে আবাসন না করে বিকল্প উপায়ে যদি বন্যাপ্রবাহ এলাকাটি সংরক্ষণ করা যায় সেটা আরো ভালো হবে। ঢাকার বাসযোগ্যতা সুস্থ রাখতে চাইলে এলাকাটি সংরক্ষণ করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’