মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা কমছে। ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার তুলনায় জমা হচ্ছে বেশি। এতে টানা তিন মাস ধরেই ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে নগদ অর্থের প্রবাহ কমছে। গত জুন শেষে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হজার ৯১৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতের নগদ অর্থ কমেছে ৩৮ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আস্থার সংকট ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছিল। তবে সুদহারের সীমা তুলে দেয়ার পর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। তাই এখন ব্যাংকে টাকা ফিরছে। আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিনিয়োগে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। যার কারণে মানুষের হাতে জমানো টাকা ব্যাংকে ফিরছে। তাই ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকের বাইরের নগদ অর্থ কমছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মে মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। হঠাৎ এক মাসে ৩৬ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বেড়ে জুন শেষে ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকায় ওঠে যায়। তবে জুনের পর থেকে তা আবার কমতে শুরু করে। জুলাইয়ে কমে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা হয়। আগস্টে আরও কমে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৬ কোটি এবং সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
জানা যায়, গত বছরের নভেম্বরের দিকে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের খবর সামনে আসার পর ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে থাকেন গ্রাহকরা। আবার সেই সময় ব্যাংকগুলোয় নতুন আমানত আসাও কমে যায়। এতে ওই ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়। ওই সময় এসব ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত তারল্য সুবিধা দিয়েছিল।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। এ সময় ব্যাংকে আমানতের সুদের হার সেভাবে বাড়েনি। যে কারণে গত বছরের নভেম্বর থেকে মানুষের হাতের টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে।
সূত্র মতে, ২০২০ সালের এপ্রিলের আগে সুদহার ছিল পুরোপুরি মুক্ত। তখন ব্যাংকঋণের সুদ
১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত ওঠেছিল। এরপর ৯ শতাংশ সুদহারে নির্দিষ্ট ছিল। গত ১ জুলাই থেকে সীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে, তবে উম্মুক্ত নয়। তবে এখন ঋণের সুদহার ক্রমেই বাড়ছে। তাই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়াচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর ধীরে ধীরে প্রতি মাসেই বাড়ছে। গত জুলাইয়ে বেড়ে হয় ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক
৫২ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ২৩ হাজার ১৩৯ কোটি টাকায়, যা গত জুন শেষে ছিল ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাই গত কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যাপক হারে কমছে। আবার ডলার সংকটের কারণে চাহিদামতো এলসি খুলতে পারছেন না। এতে চাহিদামতো রপ্তানি পণ্য উৎপাদন হচ্ছে না। উৎপাদন না হলে ব্যয় কম হয়। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে মানুষের হাতে টাকা বাড়ে। কারণ জিনিসপত্র কেনাকাটা ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। এখন এগুলো কমে আসায় মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফিরছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে। বেসরকারি খাতের ঋণে এই প্রবৃদ্ধি গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরপর কখনোই তা ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। বর্তমান মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি ঋণ কমে যাওয়া কাক্সিক্ষত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণ কমে যাওয়ার মানে আগামীতে বিনিয়োগ কমে যাবে। আর বিনিয়োগ কমলে কর্মসংস্থানও কমে যাবে। এতে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।