নগদ টাকার সংকট : সার-বিদ্যুতের দায় শোধ হবে বন্ডে

সার-বিদ্যুতের দায় শোধ হবে বন্ডেনগদ টাকার সংকটের কারণে সরকার বন্ডের মাধ্যমে সার ও বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভর্তুকি বাবদ দায় মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে সার আমদানি বাবদ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যাংক ঋণের পরিমাণ জানতে চেয়ে শিল্প মন্ত্রণালায় ও বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ব্যাংক ঋণের সমপরিমাণ বন্ড ইস্যু করে তা পরিশোধ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সারের ভর্তুকি বাবদ গত জুন পর্যন্ত সরকারের কাছে বিসিআইসির পাওনা ৮ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে ভর্তুকি বাবদ আরও কিছু বকেয়া যোগ হয়েছে। যথাসময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সরকারি চার ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এ কারণে ব্যাংকগুলো ইউরিয়া সার আমদানির নতুন এলসি খুলতে চাচ্ছে না। অর্থ পেতে বারবার চিঠি দিচ্ছে বিসিআইসি। কিন্তু সরকারের কাছে পর্যাপ্ত নগদ টাকা না থাকায় অর্থ ছাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিকে খেলাপি ঋণের হাত থেকে রক্ষায় ব্যাংকের দায়ের সমপরিমাণ বিশেষ বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মোট ভর্তুকি নয় বরং বিসিআইসির প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ব্যাংকের দায় নির্ধারণ করে দিলে সে পরিমাণ বন্ড ইস্যু করা হবে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশেষ বন্ড অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে দেওয়া হবে। ব্যাংক সে বন্ডের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, সরকারি দায়ের বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যুর নজির আগেও রয়েছে। প্রায় ২০ বছর আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায়ের বিপরীতে ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু হয়েছিল। যদিও এ ধরনের বন্ডে ব্যাংকের তারল্য সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ, ব্যাংক এর মাধ্যমে নগদ টাকা পায় না। বরং ব্যাংক এক ধরনের সম্পদ পায়, যাতে সরকারের গ্যারান্টি আছে। শুরুতে বন্ডের বিষয়টি ব্যাংকের এসএলআর হিসেবে গণ্য করা হয়নি। পরে এটিকে এসএলআরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, স্পেশাল বন্ডকে এসএলআর হিসেবে গণ্য করা হলে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়বে। কারণ এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এসএলআর সংরক্ষণের জন্য সরকারি সিকিউরিটিজে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হতো, বিশেষ বন্ডের ক্ষেত্রে সেখান থেকে বন্ডের সমপরিমাণ অর্থ বাদ যাবে। ফলে এ অর্থ তখন ব্যাংক অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে।

জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে বিদ্যুৎসহ অন্য খাতে ভর্তুকির চাহিদা বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সরকারের ঋণের দায়ও বেড়েছে। এদিকে নির্বাচনের কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে বাড়তি বরাদ্দ দাবি করছে। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারের রাজস্ব আয় হচ্ছে না। এ কারণে সরকারের কোষাগারে নগদ টাকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক সমকালকে বলেন, অনেক দিন ধরে দেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত সমস্যা থাকায় এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। রাজস্ব বাড়াতে না পারায় সরকারের কাঙ্ক্ষিত ব্যয় সম্ভব হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এখন সরকারকে কিছু একটা করতে হবে। তাই দায় পরিশোধে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার আদলে বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব উদ্যোগে বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন কার্যকরী হবে না।
তিনি আরও বলেন, সংগত কারণেই বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য রাজস্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনীতিতে একটা মন্দাভাব বিরাজ করছে। এ অবস্থায় রাজস্ব বাড়ানো সহজ নয়। অর্থনীতির এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে ৬ হাজার ২৩২ কোটি, কৃষি খাতে ২৬ হাজার ৫৫ কোটি ও সারে ২৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে।

লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব না পাওয়ায় সরকারের অর্থ সংকট বাড়ছে। ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে এ সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছে সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত এ প্রচেষ্টায় তেমন সাফল্য আসেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আহরণে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাজেটের ঘাটতি সংস্থানে সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে উচ্চ সুদেও ঋণ নিচ্ছে। এরই মধ্যে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠে গেছে ১১ শতাংশে। তার চেয়ে বেশি মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।

সমকাল