দেশে চলতি ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ। দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজারে। সে অনুযায়ী তিন মাসের ব্যবধানে কর্মসংস্থান কমেছে ৩ লাখ ৯০ হাজার মানুষের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ত্রৈমাসিক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতি প্রান্তিকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিবিএস। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক চলাকালে জেলা পর্যায়ের ৩০ হাজার ৮১৬টি খানা থেকে প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে জানালেন বিবিএসের ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড লেবার উইংয়ের উপপরিচালক আজিজা রহমান। প্রতিবেদনে কর্মসংস্থান হ্রাসের পরিসংখ্যান উঠে এলেও এর পেছনের কারণগুলো উঠে আসেনি। এ বিষয়ে সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো, বিবিএস শুধু পরিসংখ্যানের মাধ্যমে মাঠের চিত্র তুলে ধরে। এর পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন শুধু গবেষকরা।
তিন মাসের ব্যবধানে শ্রমবাজারে প্রায় ৪ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণ জানতে অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। তাদের অধিকাংশই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কর্মসংস্থান হ্রাসের কারণ হিসেবে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চাপে পড়াকে দায়ী করছেন সবচেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য, ডলার সংকটে শিল্প খাতে কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্নমুখী ব্যক্তি খাতের ভোগ। এ দুয়ের সম্মিলিত চাপে পড়েছে শিল্প খাতের চাহিদা ও উৎপাদন। কাজ হারাচ্ছেন শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের অনেকে। আবার গ্রামাঞ্চলেও মৌসুমি কৃষি শ্রমিকদের একাংশ বছরের একটি সময় পার করেন কর্মহীনতায়। এসব বিষয়েরই সম্মিলিত প্রভাব দেখা যাচ্ছে বিবিএসের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শিল্প খাতে শ্রমিক কমে যাওয়া চিন্তার বিষয়। আমদানি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে এসেছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি চলছে তুলনামূলক কম সক্ষমতা নিয়ে। এছাড়া কৃষি খাতে শ্রমিক কমে যাওয়ার পেছনে ফসলের মৌসুমসংক্রান্ত বিষয়গুলোরও প্রভাব থাকতে পারে।’
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় স্বল্প আয়ের শ্রমজীবীদের জন্য নগরাঞ্চলে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে। এমনই একজন খুলনার তেরখাদা উপজেলার নাওডুবি গ্রামের লিজা সুলতানা। রাজধানীর একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন তিনি। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় সম্প্রতি চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ শহরে কীভাবে টিকে থাকব! আমার বেতন বাড়েনি। কিন্তু খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে গ্রামে চলে এসেছি।’
শুধু রাজধানী নয়, অনেক জেলা শহর থেকেও শ্রমিকদের গ্রামমুখী হতে দেখা যাচ্ছে। যশোর শহরে বিসিকের একটি কারখানায় চাকরি করতেন একই জেলার ঝিকরগাছার মাটিকুমড়া গ্রামের আছিয়া খাতুন। চাকরি ছেড়ে এখন গ্রামে গিয়ে বসবাস করছেন তিনি।
বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কর্মসংস্থান হারানোদের মধ্যে সিংহভাগই নারী, যার সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার। অন্যদিকে কর্মসংস্থান হারানো পুরুষের সংখ্যা ২০ হাজার।
মূল্যস্ফীতির চাপ শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার। বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শহরে থেকে যদি শ্রমিকরা তাদের জীবন ধারণের ব্যয় নির্বাহ না করতে পারেন তাহলে কেন তারা শহরে থাকবেন? বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ কমে গেছে। এর ফলে অনেক শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে। আবার কর্মসংস্থান কমায় জীবনযাত্রা খারাপ হয়ে পারিবারিকভাবেও সমস্যায় পড়ছেন অনেক শ্রমিক। তাই অনেকে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই কাজ বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।’
শিল্পোদ্যোক্তারাও বলছেন, শ্রমিকের সংখ্যা এখন কমছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনমাফিক শ্রমিক পাওয়াও যাচ্ছে না। কোনো কোনো উদ্যোক্তা এখন অটোমেশনের মাধ্যমে শ্রমিকের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মো. খসরু চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম এখন আর পোশাক খাতে আসছে না। আগে গেটের কাছে অনেক শ্রমকি দেখা গেলেও এখন সে ভিড় কমে গেছে। তাই শ্রমিক সংকটের বিষয়টি আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শ্রমিক সবচেয়ে বেশি কমেছে কৃষি খাতে। এ সময় কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ৩ কোটি ১৯ লাখ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখে। সে অনুযায়ী তিন মাসের ব্যবধানে খাতটিতে শ্রমিক কমেছে প্রায় ৮ লাখ।
এর কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষি শ্রমিক ধারাবাহিকভাবে সবসময়ই কমছে। করোনার পর অনেকে চাকরি হারিয়ে কৃষিতে এসেছিলেন। আবার এখন তারা কৃষি ছেড়ে বিদেশে বা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। যান্ত্রিকীকরণের কারণেও কৃষি শ্রমিক কমতে পারে।’
যান্ত্রিকীকরণের কারণেও কৃষিতে শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত কমছে বলে মনে করছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. ফা হ আনসারী বলেন, ‘তিন-চার বছর আগে সব ধান কাটত শ্রমিকরা। আর এখন ১২ শতাংশ জমিতে ধান কাটা হয় যন্ত্রের মাধ্যমে। আগে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হতো মাত্র ৩০ শতাংশ জমি। এখন তা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণের কারণে কৃষিতে শ্রমঘনত্ব কমছে।’
বছরের প্রথম প্রান্তিকে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা নেমে এসেছে ৬০ দশমিক ৭৪ শতাংশে। এ সময় শিল্প খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ২২ লাখ থেকে কমে ১ কোটি ২১ লাখে নেমে এসেছে। তবে সেবা খাতে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৫ লাখ।
রিজার্ভ ধরে রাখার নীতি সার্বিক কর্মসংস্থান সংকুচিত করে আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘রিজার্ভ সংকট প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সংকুচিত করে ফেলেছে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থান কমছে। আর এটি দারিদ্র্যের বিষয়টিকেও আরো গভীর করছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার বহুমুখী সংকট মোকাবেলায় দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত, রিজার্ভ ধরে রাখতে প্রবৃদ্ধিকে সংকুচিত করা। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প ব্যয় চলমান রাখা, যেমন ডিসিদের গাড়ি দেয়া। সেখানে ব্যয় কমছে না। এটিকে স্বল্পমেয়াদি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির নীতি কৌশল ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এখানে কর্মসংস্থান ধরে রাখার বিষয়টিকে সে অর্থে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকারের সার্বিক নীতিকৌশল পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখা জরুরি।’
বনিক বার্তা