তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ২৫ এমপির শাস্তি নিয়ে আ’লীগে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ২৫ এমপির শাস্তি নিয়ে আ’লীগে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ২৫ এমপির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা দ্বিধাবিভক্ত। এই মন্ত্রী ও এমপির স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয় পেয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ারই সুযোগ ছিল না।

দফায় দফায় হুঁশিয়ারি দিয়েও অনেক এমপির স্বজনকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। হাতেগোনা দু-একজন এমপির স্বজন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এ নিয়ে দলে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তবে শীর্ষ নেতার কেউ কেউ বলেছেন, অপছন্দের এমপিদের ঠেকানোর জন্য দু-একজন নীতিনির্ধারক নেতা শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন। এ নিয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে কোনো আলোচনাই হয়নি।

অবশ্য উপজেলা নির্বাচনের শুরুতেই ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন তাদের কোনো না কোনোভাবে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। গত সংসদ নির্বাচনে ৭৩ জন এমপি দলের মনোনয়ন পাননি। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন ২৫ জন।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘আমি আর নির্বাচনই করব না। চারবার এমপি হয়েছি। আমার আর এমপি হওয়ার দরকার নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নেতা মানি। তাঁর সিদ্ধান্ত অবশ্যই মেনে নেব। এ ছাড়া অন্য কারও সিদ্ধান্ত মানব না।’ একরাম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরী নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদের ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর একটি অংশ ক্ষুব্ধ। আব্দুস শহীদ মৌলভীবাজার-৪ আসনের এমপি। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘অনেক হয়েছে। জনগণ আমাকে সাতবার নির্বাচিত করেছেন। আর নির্বাচন করব না।’

সাংগঠনিক শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। তবে সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ও রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন জানিয়েছেন, কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হবে। এ ক্ষেত্রে আলোচিত এমপিদের সতর্ক করা হতে পারে।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা বলেছেন, অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু এমপি, গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক এমপি, আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি এবং জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী এমপিসহ অনেক এমপির স্বজনই নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাহলে অন্য এমপিদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া প্রায় সব উপজেলায় নির্বাচনে দলের এমপিরা কাউকে না কাউকে সমর্থন দিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন। দলের সিদ্ধান্ত না মানলেও এমপিদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে অনেক শীর্ষ নেতাই জানান। সেই সঙ্গে যে এমপিদের স্বজন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, তারাও সাংগঠনিক শাস্তির মুখোমুখি হবেন না বলে জানা গেছে।

দলের সভাপতিমণ্ডলী ও সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য বলেছেন, দলীয় নির্দেশ না মানলে বহিষ্কারের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সংসদের সদস্যপদ হারাবেন, তাই তাদের বহিষ্কারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে দলের বেশির ভাগ নেতা মনে করছেন, নানাভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এমপিদের তিরস্কার করার পাশাপাশি দলীয় পদ-পদবি কেড়ে নেওয়া হতে পারে। এমনকি সাংগঠনিক যোগ্যতা থাকার পরও তারা নতুন করে দলের পদ-পদবি নাও পেতে পারেন। তা ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়াটা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অভিযুক্ত মন্ত্রীরা যে কোনো সময় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়তে পারেন। সেই সঙ্গে তিনবার বিজয়ী এমপিদের মধ্যে যাদের মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের মন্ত্রিসভায় নেওয়ার সম্ভাবনাও কমতে পারে। অবশ্য এ বিষয়ে এখনই দলের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে না। তবে এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা।

যে এমপিদের স্বজন নির্বাচনে জয় পেয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এমনকি নির্বাচিত স্বজনকে সমর্থন দেননি– এমন এমপির তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও দলের আট সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এস এম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এবং সুজিত রায় নন্দী উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদের চিত্র তুলে ধরে সাংগঠনিক রিপোর্ট তৈরি করছেন। এসব নিয়ে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনার প্রস্তুতি রয়েছে।

উপজেলা নির্বাচনে দলের ১৮ জন এমপির স্বজন জয় পেয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাতিজি জামাই বিশ্ব প্রদীপ ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির রামগড়ে, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের আলী আজগার টগরের ভাই মুনসুর বাবু দামুড়হুদায়, কুষ্টিয়া-৩ আসনের মাহবুবউল-আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা সদরে, বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল সারিয়াকান্দিতে, সাহাদারা মান্নানের ভাই মিনহাদুজ্জামান লিটন সোনাতলায়, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান সদরে, নীলফামারী-১ আসনের আফতাব উদ্দিন সরকারের ভাই আনোয়ারুল হক সরকার মিন্টু ডিমলায়, লালমনিরহাট-২ আসনের নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ কালীগঞ্জে, জামালপুর-১ আসনের নুর মোহাম্মদের ভাই নজরুল ইসলাম বকশীগঞ্জে, ঢাকা-১২ আসনের এমপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের শ্যালক হামিদ লতিফ ভূঁইয়া কুমিল্লার বরুড়া, পাবনা-৩ আসনের মকবুল হোসেনের ছেলে গোলাম হাসনাইন রাসেল ভাঙ্গুড়া, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদ রায়পুরে, কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদের ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে, কক্সবাজার-৪ আসনের শাহীন আক্তার চৌধুরীর ভাই জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী উখিয়ায়, দিনাজপুর-৬ আসনের শিবলী সাদিকের ভাই তাজওয়ার মোহাম্মদ ফাহিম নবাবগঞ্জে, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমএ মান্নানের ছেলে সাদাত মান্নান অভি শান্তিগঞ্জে, পিরোজপুর-১ আসনের অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমের ভাই এসএম নুর ই আলম সিদ্দিকী নাজিরপুরে, নোয়াখালী-৪ আসনের একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরী সুবর্ণচরে এবং নোয়াখালী-৬ আসনের মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী হাতিয়ায় জয় পেয়েছেন।

সাতজন স্বতন্ত্র এমপির স্বজনও নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে বগুড়া-৩ আসনের খান মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল মেহেদী বাঁধনের বাবা সিরাজুল ইসলাম খান রাজু আদমদীঘিতে, কুমিল্লা-২ আসনের অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের স্ত্রী রেহানা বেগম হোমনায়, কুমিল্লা-৩ আসনের জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ছেলে আহসানুল আলম সরকার কিশোর মুরাদনগরে, কুমিল্লা-৪ আসনের আবুল কালাম আজাদের ভাই মামুনুর রশীদ মামুন দেবিদ্বারে, কুমিল্লা-৫ আসনের এমএ জাহেরের ভাতিজা আবু তৈয়ব অপি ব্রাহ্মণপাড়ায়, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের ফয়সাল আহমেদ বিপ্লবের চাচা আনিছ-উজ জামান সদরে এবং নরসিংদী-৩ আসনের সিরাজুল ইসলাম মোল্লার স্ত্রী ফেরদৌসী ইসলাম শিবপুরে নির্বাচিত হয়েছেন। এই স্বতন্ত্র এমপিরা আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের পদে রয়েছেন।

samakal