ডেস্ক
‘এভাবে কেউ পদ্মশ্রী দেয়? এরা জানে না আমি কে? নব্বই বছরে আমায় শেষে পদ্মশ্রী নিতে হবে? আর এই ফোন করে বললেই চলে যাব আমি? শিল্পীদের কোনো সম্মান নেই?’ হতাশা আর অপমানে বেদনাহত বর্ষীয়ান সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানান। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন অর্থাৎ গতকাল ঘোষণা করা হয় পদ্মশ্রী পুরস্কারের নাম। এদিন পদ্মশ্রী সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার আগে থেকে কিছু জানায়নি। তা ছাড়া, ফোনে যেভাবে পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে কিংবদন্তি শিল্পীর কাছে, এ প্রক্রিয়া তাঁর কাছে যথেষ্ট অপমানজনক মনে হয়েছে বলেই তিনি জানিয়েছেন ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর কাছে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পদ্মশ্রী সম্মানের প্রস্তাব আসায়, তিনি অসম্মান বোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবারই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে ফোন আসে এই সম্মান গ্রহণ করার জন্য। শিল্পী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এই সম্মান গ্রহণ করতে পারবেন না। শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে চলচ্চিত্রের গান, আধুনিক গানের অ্যালবাম—সব মিলিয়ে তাঁর কাজের পরিধি অনেকটাই। ১২ বছর বয়স থেকে গান গাইছেন। সংগীতের পেছনে জীবনের ৭৫টি বছর ব্যয় করেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর জুটি বহু বছর ধরে বাঙালির মনজুড়ে আছে। একসময় সুচিত্র সেনের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’, ‘মধুমালতী’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’, ‘তুমি নাহয়’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’, ‘যমুনা কিনারে’সহ অনেক কালজয়ী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। এসব না জেনে কেউ তাঁকে সম্মান দিতে চাইলে তা তিনি গ্রহণ করবেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। বরেণ্য এ শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম।
প্রায় সব গণমাধ্যমে একই প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমি বলে দিয়েছি, আমার পদ্মশ্রীর কোনো দরকার নেই। শ্রোতারাই আমার সব।’ তিনি বলেন, ‘আমার শরীরটা বেশ খারাপ। আমাকে পদ্মশ্রী নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, দিল্লি থেকে ফোন করা হয়েছে। আমি বলেছি, না আমি পারব না এই সম্মান নিতে যেতে। তারা কারণ জানতে চায়, আমি বলেছি, আমার মন চাইছে না। এটা অনেক বড় অপমান আমার জন্য। এই অপমানের সম্মান আমি গ্রহণ করতে পারব না। আমি কী কাজ করেছি, ওরা তা জানে না। আমাকে চেনেও না। সংগীতজগত সম্পর্কেও ওরা অবগত নয়। তাই কিছু না জেনেই কথা বলেছে, সেটাই খারাপ লাগা। একেবারে ঘোষণার শেষ পর্যায়ে এসে আমায় ফোন করছে, এত দিন পর মনে হলো তাদের, আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারি না এখন, মঞ্চে গিয়ে কীভাবে গ্রহণ করব এই সম্মান?’
সংবাদমাধ্যম জি ২৪ ঘণ্টাকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘সারা ভারতে যত শিল্পী আছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে আমি গান গেয়েছি। বড়ে গুলাম আলী খানের শিষ্যা আমি, তাঁর সঙ্গেও এক মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেটাই আমার জীবনের সেরা পুরস্কার। আমার দেশ আমায় যতটা ভালোবেসেছে, মানুষ আমায় যতটা নিজের করে নিয়েছে, তারপর আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই। এর আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও এই সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এ জন্যই।’
ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের পাশাপাশি চলচ্চিত্র দুনিয়াতেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একসময় হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও চুটিয়ে গান গেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি নিজস্ব অ্যালবামও বের করেছেন। ১৯৭১ সালে ‘জয়জয়ন্তী’ ও ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা। এ ছাড়া ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার তাঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করে।