সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে তথ্য গোপন করে ৬২ দিনে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে দেওয়া হয় বিপুল অঙ্কের এ ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, নতুন ঋণ না নিয়ে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা আগের দায় সমন্বয় করেছে। সরকার পরিবর্তনের পর তথ্য গোপন করে টাকা ছাপিয়ে এ ঋণ দেওয়ার ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন এক সময়ে তথ্য গোপন করে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দেয়, বাজারে টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সরাসরি কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। কেননা সরাসরি ঋণ দিলে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়। গভর্নরের পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করে পলাতক আব্দুর রউফ তালুকদার বিভিন্ন বক্তব্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমছে বলেও জানান।
সাধারণভাবে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যু করে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়। গত বছরের জুনের আগ পর্যন্ত বিল ও বন্ডের নিলামে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর তা আরোপিত (ডিভল্বমেন্ট) হতো। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারকে দেওয়া ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই দেয় ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেও তাই দেখানো হয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দেখানো হয় ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দেখানো হয় ৯৭ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে ঋণ না বেড়ে উল্টো ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মতো উপকরণ ইস্যু ছাড়াও সরকার জরুরি প্রয়োজনে ‘উপায়-উপকরণ আগাম’ এবং ‘ওভার ড্রাফট’ হিসেবে ঋণ নিতে পারে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত দুটি ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারিত ছিল আট হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত যা ছয় হাজার কোটি টাকা ছিল। তবে সম্প্রতি সীমা বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। সীমার বাইরে সরকারের জরুরি টাকার দরকার হলে নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে তা নিতে পারবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ‘ওভার ড্রাফট’ খাতের সীমা সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করতে পারে। তবে ঋণ ৯০ দিনের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে সরকারকে ওভার ড্রাফট খাতে ঋণ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত জুনে এর স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গভর্নরের মৌখিক নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়।
সরকারি চাকরিতে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে গত ১ আগস্ট বৃহস্পতিবার ঘটনাত্তোর অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সাপ্তাহিক দু’দিন ছুটির পর ৪ আগস্ট অফিস খোলা ছিল। ওই দিন কারফিউ ভেঙে ছাত্র-জনতা সরকার পতনের এক দফা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এর পরদিন ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। যে কারণে এই ঋণের ঘটনাত্তোর অনুমোদন দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। গভর্নর পদত্যাগ করে পালানোর কারণে এ নিয়ে আতঙ্কে আছেন কর্মকর্তারা।
মন্তব্য জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থায়ন করা মানেই টাকা ছাপানো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো বলেই দিয়েছিল, ২০২৩ সালের জুনের পরে টাকা ছাপানোর পথে নেই। তাহলে তো মিথ্যা বলেছে। সরকারকে এত টাকা ঋণ দিলে তা আগুনে ঘি ঢালার মতো মূল্যস্ফীতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হলো– নির্ধারিত সীমা না মেনে ঋণ দিয়ে একটি অনিয়ম করা হয়েছে। এ জন্য একটি তদন্ত কমিটি করা যেতে পারে। ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যারা ছিলেন, তারা যদি গভর্নরের মৌখিক নির্দেশে দিয়ে থাকেন, তাহলে তারা ওই কমিটিকে বলবেন। টাকার গতিপথ বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। ব্রিফকেসে করে কেউ নিয়ে যায়নি। কোথায় কীভাবে খরচ হয়েছে, খতিয়ে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে নিয়ম লঙ্ঘন করে সরকারকে সীমার বেশি কবে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ওভার ড্রাফট খাতে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ৮২৬ কোটি টাকার ঋণস্থিতি ছিল গত বছরের ২৬ জুন। এর মানে সীমার বেশি ছিল ৬২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। পরের দিন ২৭ জুন স্থিতি নামে ৫৫ হাজার ২২০ কোটি টাকায়। অর্থবছরের শেষ দিন কমিয়ে আনা হয় ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদার একচ্ছত্র নিয়মকানুনের পাত্তা দিতেন না। সরকারকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়টি তিনি আমলে নেননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন অর্থ উপদেষ্টা ও নতুন গভর্নর বিষয়টি নিশ্চয় খতিয়ে দেখবেন। গত ১ আগস্ট ঘটনাত্তোর অনুমোদন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
samakal