ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রত্ব শেষ, তবু হলে থাকছেন নেতারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল মিলিয়ে শতাধিক কক্ষ গণরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব কক্ষে একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। তবে বিজয় একাত্তর হলের এই গণরুমটিতে থাকছেন দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। গত ১৯ মার্চ দুপুরে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে মোট কক্ষ আছে ১০৪টি। দুটি কক্ষ বাদে সব কটিতে শয্যা আছে চারটি করে। বাকি দুটিতে একটি করে শয্যা। সে হিসাবে এই হলে মূলত আবাসনসুবিধা আছে ৪১০ জন ছাত্রের। বাস্তবে সেখানে থাকছেন প্রায় ৯০০ জন। হল প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলটিতে প্রায় ২০০ জন আছেন, যাঁদের পড়ালেখা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ‘গণরুম’গুলোতে গাদাগাদি করে থাকছেন প্রথম বর্ষের শেষের দিকে থাকা ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে প্রথম বর্ষের নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। তাঁরা হলে ওঠা শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

এই হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, কে হলে উঠতে পারবেন, কে পারবেন না—এসব নির্ধারণ করে দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলগুলোর চিত্র কমবেশি এফ রহমান হলের মতোই। কিছুটা ব্যতিক্রম ছাত্রীদের হলে। ছাত্রীদের হলেও আবাসনসংকট আছে, গণরুম আছে। তবে সেখানে হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে।

ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও ছাত্রদের হলগুলোতে মোট কতজন অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নেই। সম্প্রতি আবাসিক হলগুলোর কক্ষভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। কোন কক্ষে কারা থাকেন, কাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে—এসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, তাদের এই কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। এখন পর্যন্ত তারা যে তথ্য পাচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে বিভিন্ন হলে থাকছেন, এ সংখ্যা অন্তত তিন হাজার হবে; যা হলে থাকা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ১৫ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী এখন ৩৭ হাজার ১৮ জন। আবাসিক হল আছে ১৯টি। এর মধ্যে ছাত্র হল ১৩টি, ছাত্রী হল ৫টি এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১টি হল। বিভিন্ন হলের অধীন হোস্টেল আছে চারটি। হলের প্রতিটি শয্যায় সাধারণত দুজনের আবাসন ধরে হিসাব করে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থা আছে ১৬ হাজার ৫৪৬ জন শিক্ষার্থীর।

শিক্ষার্থী ৩৭ হাজার। আবাসনের ব্যবস্থা সাড়ে ১৬ হাজারের।

■ বাস্তবে থাকেন ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।

■ ‘গণরুমে’ গাদাগাদি করে থাকেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

■ ছাত্রত্ব শেষেও নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে হলে থাকেন অনেকে।

বাস্তবে এখন কত শিক্ষার্থী হলগুলোতে থাকছেন, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে সে সংখ্যা ২০ হাজারের কম হবে না। সব হল মিলিয়ে শতাধিক কক্ষ ব্যবহার করা হয় গণরুম হিসেবে, যেখানে প্রতিটি কক্ষে একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। এই কক্ষগুলোর বেশির ভাগ চার শয্যার। আরও বড় কক্ষগুলোতে আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকেন। যেমন বিজয় একাত্তর হলের একটি বড় কক্ষে শতাধিক ছাত্র থাকেন।

বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ১৮টি ও  হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ১১টি কক্ষ গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ও কবি জসীমউদ্‌দীন হলে ৮টি করে; স্যার এ এফ রহমান হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৬টি করে; জগন্নাথ হলে ৫টি, অমর একুশে হলে ২টি এবং বিজয় একাত্তর হলে বড় ১টি কক্ষ গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 মেয়েদের জন্য নির্ধারিত বেগম রোকেয়া, শামসুন নাহার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী ও কবি সুফিয়া কামাল হলেও গণরুম আছে। প্রথম বর্ষে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির হওয়ার পর মেয়েদের হলগুলোতে ৫ থেকে ১০টি কক্ষ গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকট আগেও ছিল। তবে গত এক দশকে সেশনজট প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। গত শিক্ষাবর্ষে ভর্তির ক্ষেত্রে ১ হাজার ১৬৩টি আসন কমানো হয়। গত ১৫ বছরে দুটি নতুন হল এবং দুটি হলে দুটি নতুন ভবন চালু হওয়ায় আবাসনসুবিধা বেড়েছে। সব মিলিয়ে আবাসনসংকট কিছুটা কমার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। এর বড় কারণ, হলগুলো নিয়ন্ত্রণ ছাত্রসংগঠনের হাতে থাকা এবং পড়ালেখা শেষ করার পরও একটি অংশ দীর্ঘদিন হলে অবস্থান করা।

শিক্ষার্থী ও হল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাসনসংকটকে পুঁজি করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হয় মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার শর্তে। প্রথম বর্ষে হলে ওঠার পর ছাত্রদের প্রায় সন্ধ্যা বা রাতে ‘গেস্টরুমে’ হাজিরা দিতে হয়। সেখানে নির্যাতনের অভিযোগও কম নয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচি চলাকালে অতিরিক্ত গরমে এক শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়েন।

অন্যদিকে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের একটি বড় অংশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এর বাইরে যাঁরা থাকছেন, তাঁরাও মূলত ছাত্রলীগের নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করেই থাকেন। হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টন, কারও ছাত্রত্ব শেষে হল ছাড়তে বলা বা এ ধরনের উদ্যোগ নিতে গেলে হেনস্তার শিকার হতে পারেন—এমন আশঙ্কা থেকে শিক্ষকেরা এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেন না।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, হলগুলোর কক্ষভিত্তিক জরিপের কাজ শেষ হলে আগামী মাসে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের একটি অংশ রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন; এ অভিযোগ সঠিক। অনেকে হলে থাকেন চাকরি হওয়ার আগপর্যন্ত, হলে থেকে চাকরির প্রস্তুতি নেন। হল প্রশাসন যখন রাজনীতিতে যুক্তদের বের করতে পারে না, তখন ছাত্রত্ব শেষ হওয়া অন্য শিক্ষার্থীদেরও এ বিষয়ে কিছু বলার নৈতিক জায়গাটা থাকে না। তবে এ বিষয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে।

উপাচার্য জানান, শিক্ষার্থীদের কক্ষভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। একটি অ্যাপে সব তথ্য থাকবে। ড্যাশ বোর্ডে ক্লিক করে দেখা যাবে, কোন কক্ষের কে কোন বর্ষের শিক্ষার্থী। আবাসিক শিক্ষকেরা এটি নিয়মিত তদারকি করবেন।

হলের চিত্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলভেদে এক, দুই ও চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ আছে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক শয্যায় দুজন করে থাকেন। এভাবে তিন-চার ফুট প্রস্থের একটি খাটে দুজন করে থাকাকে বলা হয় ‘ডাবলিং’। তবে ব্যতিক্রম আছে দুটি ক্ষেত্রে। একটি হলো গণরুম, যেখানে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী থাকেন গাদাগাদি করে। তাঁরা সবাই প্রথম, দ্বিতীয়—কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অন্যদিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক শয্যা, দুই শয্যার কক্ষগুলোতে থাকেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। যেসব হলে এক বা দুই শয্যার কক্ষ নেই, সেখানে নেতারা থাকেন এক খাটে একজন (সিঙ্গেল) করে। তাঁদের অনেকে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও হল ছাড়েন না। অনেকে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও হলে থেকে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সব হলেরই কমবেশি একই চিত্র। তবে মুসলমান শিক্ষার্থী ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্ধারিত জগন্নাথ হলের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সেখানে আবাসনসংকট কিছুটা কম। কিন্তু সেখানেও ছাত্রত্ব শেষ হওয়া ও বহিরাগত অনেকে থাকছেন বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এখন নতুন করে শিক্ষার্থীদের সংযুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের জন্য এই হল নির্ধারণ করার কথা ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে কিছুদিন আগপর্যন্ত এই হলেও আবাসনসংকট ছিল প্রকট। ছাত্ররা থাকতেন হলের বারান্দায়। এখনো ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা এই হলে অবৈধভাবে থাকছেন।

গণরুমে গাদাগাদি

২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয় বিজয় একাত্তর হল। এখানে ১১ তলাবিশিষ্ট দুটি ভবনে মোট এক হাজার শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা আছে। বাস্তবে থাকেন প্রায় দ্বিগুণ। এই হলের মেঘনা ব্লকের বিভিন্ন তলায় বড় হলরুম করা হয়েছে টেলিভিশন কক্ষ ও খেলার কক্ষের মতো কাজে ব্যবহার করার জন্য। চতুর্থ তলার এমন একটি বড় কক্ষ এখন ব্যবহার করা হয় গণরুম হিসেবে। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় গণরুম হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি বিজয় একাত্তর হলের ওই গণরুমে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল কক্ষটিতে সারি সারি বিছানা পাতা। বিছানার পাশে সারি করে ট্রাংক রাখা। যেখানে ছাত্রদের জামাকাপড়, বইপত্র। চলাচলের জন্য সরু কিছু জায়গা ফাঁকা। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই কক্ষে প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থী থাকেন। বেশির ভাগ প্রথম বর্ষের শেষের দিকে। এই কক্ষে চারটি ‘ব্লক’ (অংশ) নির্দিষ্ট করা আছে। এই চারটি ব্লক ছাত্রলীগের চার নেতার ব্লক হিসেবে পরিচিত। এই চার নেতার অনুসারীদের মাধ্যমে হলে ওঠা ছাত্ররা সংশ্লিষ্ট নেতার নামে নির্ধারিত অংশটিতে থাকেন।

এফ রহমান হলে গিয়ে দেখা যায়, ওই হলের গণরুমগুলো নিচতলায়। কক্ষের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের ট্রাংকগুলো রেখেছেন বারান্দায়। একটি কক্ষে ঢুকে দেখা যায়, সেখানে পুরো মেঝেতে বিছানা পাতা। পড়ার কোনো টেবিল নেই। আসলে টেবিল রাখার জায়গা নেই। পড়তে হয় বিছানায় বা হলের নির্ধারিত পাঠকক্ষে (রিডিং রুম) গিয়ে। এই কক্ষগুলোর বাসিন্দারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

এখানকার কয়েকজন ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা এক বছরের বেশি সময় ধরে গাদাগাদি করে থাকছেন। রাতে ছারপোকার কামড়ে ঘুমাতে পারেন না। এর সঙ্গে রয়েছে মশার উৎপাত। তাঁরা প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় হলের পাঠকক্ষে ঢোকার অনুমতি পেতেন না। এখন সে সুযোগ পাচ্ছেন।

এই ছাত্রদের মতে, নতুন শিক্ষার্থী ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। এখনো হলে অনেকেই থাকছেন, যাঁদের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে। তাঁরা হল ছেড়ে দিলে সংকট কিছুটা কমত। কিন্তু তাঁদের বের করার কোনো চেষ্টা নেই হল কর্তৃপক্ষের।

স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যের নির্দেশনায় ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও কারা হলে থাকছেন, সে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারপর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে নেই; এটি ছাত্রসংগঠনের হাতে।

এর আগে একটি হলে আবাসিক শিক্ষক থাকার সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধভাবে যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের বের করে দিতে গেলে মাঝখানে একটি দেয়াল চলে আসে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ আসে।’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তুলনামূলকভাবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের গণরুমের অবস্থা কিছুটা ভালো। তবে ঈদুল ফিতরের আগে ওই হলের একটি গণরুমে (বর্ধিত ভবন-১–এর ১১০২ নম্বর কক্ষ) গিয়ে দেখা যায়, ওই কক্ষে মেঝেতে বিছানা পেতে থাকছেন অন্তত ১৪ জন। এই গণরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত সংগঠনটির কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়।

তবু তাঁরা হলে থাকেন

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রাকিবুল হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে। তাঁর সহপাঠীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ২০১৪ ও ২০১৫ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ৬ বছরে স্নাতক ও ২ বছরে স্নাতকোত্তর—মোট ৮ বছর নিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থী থাকার সুযোগ রয়েছে। তাঁর সেই সময়সীমাও পেরিয়েছে ৫ বছর আগে। তবু তিনি থাকতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে। গতকাল শুক্রবার তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি গত সেপ্টেম্বরে হল ছেড়ে দিয়েছেন।

একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ হিল বারী বঙ্গবন্ধু হলে, অপর তিন সহসভাপতি উৎপল বিশ্বাস জগন্নাথ হলে, হাসানুর রহমান জিয়াউর রহমান হলে ও  জয়নাল আবেদীন জসীমউদ্‌দীন হলে থাকছেন।

এখন ছাত্রত্ব না থাকা সত্ত্বেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি তাহসান আহমেদ ও মেহেদী হাসান; এ এফ রহমান হলে থাকছেন সহসভাপতি খাদিমুল বাশার, রনি মুহাম্মদ ও শেখ সুজন; সূর্য সেন হলে থাকছেন সহসভাপতি নাহিদ হাসান ও তুহিন রেজা। ছাত্রলীগের সহসভাপতি খায়রুল হাসান আকন্দ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দিন থাকেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। বিজয় একাত্তর হলে থাকছেন সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ মাহামুদ, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকছেন সাবেক সহসভাপতি শেখ সাগর আহমেদ, জসীমউদ্‌দীন হলে থাকছেন সহসভাপতি শাহেদ খান, জোবায়ের হাসান ও এস এম সাহেদুজ্জামান। তাঁদের সবার ভর্তির শিক্ষাবর্ষ ২০১১-১২।

ছাত্রলীগের এই নেতাদের মতো অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীও হলে থাকছেন অবৈধভাবে। ছাত্রলীগের নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করেই তাঁরা মূলত হলে থাকেন বলে জানা গেছে।

তবে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান (সৈকত) প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫-২০ শতাংশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। বাকিরা সাধারণ ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় যদি নীতিমালা করে ছাত্রত্ব শেষে কেউ থাকতে পারবেন না, তাহলে ছাত্রলীগ এ ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। এ জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার, যেটা সবাই অনুসরণ করবেন।

তানভীর হাসানের দাবি, ছাত্রলীগ হল নিয়ন্ত্রণ করে না, তারা শুধু মানবিক কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে তোলে।

তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অনেক অছাত্র হলগুলোতে আয়েশ করে থাকছেন। অথচ প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ; কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয়, চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরাও গাদাগাদি করে গণরুম বা মিনি গণরুমে থাকেন। তিনি মনে করেন, এই আবাসনসংকট ছাত্রলীগ এবং প্রশাসনের জন্য সুবিধাজনক। কারণ, সংকট না থাকলে শিক্ষার্থীরা শয্যার জন্য কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন না। তখন তাঁরা কথা বলতে শুরু করলে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন—উভয়ের জন্য তা বিপত্তির কারণ হতে পারে।

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here