ঢাকার ‘দুর্গের দেয়াল’ ভাঙতে চায় বিএনপি

ঢাকার ‘দুর্গের দেয়াল’ ভাঙতে চায় বিএনপি.

সরকার পতনের আন্দোলন আরও কঠোর করতে ‘দুর্গের দেয়াল’ হিসেবে পরিচিত রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে নজর দিয়েছে বিএনপি। পুরো দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভাগের ১০ সাংগঠনিক ইউনিট ছাড়াও কুমিল্লাকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চলমান আন্দোলন সফল করতে অন্য জেলাগুলোকেও টার্গেট করা হয়েছে। এসব ইউনিটে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জোটের বাইরে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বৃহৎ ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম গড়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে। তাতে জামায়াতে ইসলামীকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে শুরু হওয়া এক দফার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে কাজ করছেন দলের হাইকমান্ড। ওই উদ্যোগের ফলে এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে আগের তুলনায় নেতাকর্মীর উপস্থিতি বাড়ছে। তবে তা সন্তোষজনক নয়। তবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে খুব শিগগিরই আন্দোলনে ভালো ফল আসবে।

তারা বলেন, নির্বাচন ঠেকানো আর সরকার পতনের আন্দোলনে সাফল্যের জন্য বিএনপির হাতে আছে আর মাত্র এক মাস। এই সময়ের মধ্যে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এজন্য কোন কোন জায়গায় নিজেদের দুর্বলতা ও সাংগঠনিক সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, গত এক মাসে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব জায়গায় বিকল্প পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আগামী ১৮ ডিসেম্বরের পর ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রায় নিতে এখন থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছেন দলের হাইকমান্ড। আন্দোলনে নতুন মাত্রা আনতে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের প্রকাশ্য কর্মসূচিতে চাচ্ছেন শীর্ষ নেতৃত্ব।

জানা গেছে, ঢাকার দুর্গের দেয়াল হিসেবে পরিচিত আটটি সাংগঠনিক ইউনিট– মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর জেলা ও মহানগর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগরের সাংগঠনিক শক্তি মূল্যায়ন করা হয়েছে। চূড়ান্ত আন্দোলনে এসব ইউনিটকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে কীভাবে মাঠে নামানো যায়, সেসব নিয়ে আলোচনা চলছে। যেসব ইউনিট ব্যর্থ হবে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন দলের শীর্ষ নেতারা।

বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদের চলমান আন্দোলনে অনেক জায়গায় দুর্বলতা ধরা পড়েছে। এখনও অনেক জেলায় কার্যত কোনো আন্দোলনই গড়ে ওঠেনি। জেলার দুই শীর্ষ নেতা ছাড়াও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্দিনে নেতাকর্মীকে এড়িয়ে চলছেন তারা। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর জেলা ও মহানগর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলার ওপর যতটুকু প্রত্যাশা ছিল, তার ধারে কাছেও নেই সেগুলো। মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

ওই নেতা বলেন, নরসিংদীতে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হিসেবে সাবেক এমপি সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও কার্যত তিনিও ব্যর্থ। নিজের এলাকায়ও কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি তিনি। উল্টো কোন্দল সৃষ্টি করছেন। টাঙ্গাইলে নেতা বেশি কিন্তু আন্দোলন নেই। এই তিন জেলাকে নিয়ে চরম হতাশ দলের হাইকমান্ড।

তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক আন্দোলনেও লেজেগোবরে অবস্থা বিরাজ করছে। উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক গ্রেপ্তার হওয়ার পর আন্দোলনে ভাটা পড়েছে। ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার নিজস্ব বলয় নিয়ে ব্যস্ত। পছন্দের নেতাকর্মীকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। আমিনুলের সঙ্গে কাজ করা নেতাকর্মীকে দূরে রাখা হচ্ছে। মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক নেতাকর্মীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে চলছে সমন্বয়হীনতা।

জানা গেছে, এসব সাংগঠনিক ইউনিটের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ আরেক জেলা কুমিল্লা নিয়েও ক্ষুব্ধ দলের শীর্ষ নেতারা। ঢাকার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এই জেলায় কোনো আন্দোলনই গড়ে ওঠেনি। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা বিচ্ছিন্ন করতে দাউদকান্দি থেকে শুরু করে চৌদ্দগ্রামের মহাসড়কে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার কঠোর বার্তা দেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। এ কারণে সেখানকার তিনটি সাংগঠনিক ইউনিটে নতুন সমন্বয়ক বেছে নেওয়া হয়েছে। তাদের অসহযোগিতা করছেন কুমিল্লা উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগরের নেতারা। কুমিল্লা দক্ষিণের আহ্বায়ক হাজি আমিনুর রশিদ ইয়াসিন এবং চৌদ্দগ্রামের কামরুল ইসলামকে কোথাও খুঁজে পাননি নেতাকর্মীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও আন্দোলন হয় না। কেউ কিছু করতে চাইলেও সেখানে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। এমনকি পুলিশেও ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ জেলার নেতাকর্মীর।

ঢাকা বিভাগ ছাড়াও রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকায় আন্দোলন জোরদার করতে পারেননি নেতারা। ওই সব জেলার শীর্ষ নেতারা এমনভাবে আত্মগোপনে আছেন, নেতাকর্মী তো দূরের কথা, দলের হাইকমান্ডও অনেক সময় তাদের পান না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর আর পাবনা নিয়ে চরম অসন্তুষ্ট দলের নীতিনির্ধারকরা।
খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, সাতক্ষীরাসহ বেশির ভাগ জেলায় নেতারা আত্মগোপনে গেছেন। কয়েকটি জায়গায় দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করেও কোনো ফল আসেনি। একইভাবে সিলেট, ফরিদপুর, রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশির ভাগ জেলা নিয়ে অসন্তুষ্ট বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তাদের আলটিমেটাম দিয়েও মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন শুরুর আগে– ‘হয় দায়িত্ব পালন কর, নয় তো সরে দাড়াও’ নীতিতে সব জেলাকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, আন্দোলনে সব নেতাকে মাঠে দায়িত্ব পালন করতে হয় না। কেউ কেউ সমন্বয়ের দায়িত্বও পালন করেন। ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বও দেওয়া থাকে। দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। তবুও যার যার জায়গা থেকে নেতাকর্মীরা কর্মসূচি পালন করছেন। আগামীতেও যাঁকে যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হবে তিনি সেখানে কাজ করবেন।

দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা আক্ষেপ করে জানান, দলের বেশির ভাগ নেতা মাঠে না থাকলেও তথাকথিত মনিটরিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর কর্মীরা নিজ উদ্যোগে আন্দোলন করছেন, মার খাচ্ছেন, কারাগারে যাচ্ছেন। ওই সব নেতাকে মনিটরের দায়িত্ব কে দিয়েছে, তারা কি মনিটর করেন তা একমাত্র তারা  এবং দলের শীর্ষ নেতাই ভালো বলতে পারবেন। কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলবেন, আর কর্মীরাই শুধু মার খাবেন– তাতে আন্দোলন বেশিদূর এগোবে না। দায়িত্বশীল নেতারা মাঠে না নামায় তৃণমূলে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাঁচ শতাধিক নেতা আছেন। অথচ বেশির ভাগ রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ হাতেগোনা কয়েক নেতাকে মাঠে দেখা গেছে। কেন্দ্রের মতো জেলার শীর্ষ নেতারাও মাঠে নেই। এমনকি বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদেরও খোঁজ নেই।

রাজশাহী, বরিশাল, ঢাকা, ফরিদপুরের সাংগঠনিক টিমকে খুঁজে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের। অনেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্কাইপেতে গরম গরম কথা বলেন; কিন্তু কাজের সময় তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ আন্দোলনের ভুয়া ছবি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন। ওইসব জুম মিটিংও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে– অভিযোগ বেশ কয়েকজন নেতার। তাদের দাবি, পছন্দের নেতা না হলে জুমে তাদের নেওয়া হয় না। নিজের বলয়ের না হলে আন্দোলনে সাহায্য করা হয় না।

দূর করা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা সারাদেশে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর হামলায় বিপর্যস্ত তৃণমূল। এবার তাদের রাজপথে নিয়ে আসতে সমন্বয়হীনতা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মামলা-হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আর্থিক সংকট লাঘবে নেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা। এতদিনের সিন্ডিকেট ভেঙে সরাসরি নেতার সঙ্গে কর্মীর সমন্বয় সৃষ্টির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, কেউ কূটনৈতিক তৎপরতায়, কেউ আইনি সহায়তায় আবার কেউ জনমত সৃষ্টিতে কাজ করছেন। পেশাজীবী নেতারাও বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে থাকেন। এসব কাজকেও গুরুত্ব দিতে হবে। তবে যারা কোনো কিছুই করেন না, তারা দল ও দেশকে ঠকাচ্ছেন।

সমকাল