যুগান্তর প্রতিবেদন
ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে সড়কের মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে নজর রেখেছে র্যাব। সড়কে সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই করা হয় তল্লাশি। সবচেয়ে বেশি জেরার মুখে পড়েন রাজধানীর আশপাশের এলাকা থেকে ঢাকায় ঢুকতে চাওয়া মানুষ। তাদের দেহ ও সঙ্গে থাকা ব্যাগের পাশাপাশি মুঠোফোনও তল্লাশি করে পুলিশ এবং সরকারদলীয় কর্মীরা। গোলাপবাগে সমাবেশ হলেও নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ। সড়কে বসানো হয় ব্যারিকেড। বন্ধ ছিল সব ধরনের যান চলাচল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনের সামনেও ছিল পুলিশের বাড়তি সতর্ক অবস্থান। সবমিলিয়ে বড় ধরনের অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ছাড়াই শেষ হয় বিএনপির সমাবেশ। শুধু মুগদায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়া ও অগ্নিসংযোগের একটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে প্রায় ৩৪ হাজার পুলিশ সদস্য মাঠে নামে। পাশাপাশি র্যাব, ছয় হাজার আনসার সদস্য, এপিবিএন সদস্যরাও মোতায়েন ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিল সাঁজোয়াযান ও জলকামান। সমাবেশস্থলের আকাশে দেখা গেছে ড্রোনও। গোলাপবাগ মাঠ ঘিরে ভাগ ভাগ হয়ে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সমাবেশ ঘিরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশেরও (ডিবি) শক্ত অবস্থান দেখা গেছে। তবে মানুষকে মাঠে প্রবেশে বাধা দেয়নি পুলিশ। এতে করে মাঠ ছাড়িয়ে মানুষের উপস্থিতি আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শহরের প্রবেশপথসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও ছিল পুলিশের কঠোর নজরদারি। এছাড়া সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখা গেছে।
নয়াপল্টনে পুলিশের ব্যারিকেড : এদিকে বিএনপির সমাবেশের মধ্যেও দলটির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ। নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত সড়কটি ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। সড়কের উভয় পাশের গলিতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এই এলাকার সব দোকানপাট ও অফিস বন্ধ ছিল। ‘নাশকতার আশঙ্কা’ থেকেই পুলিশ সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) একেএম হাফিজ আক্তার। শনিবার দুপুরে পল্টনের নাইটিঙ্গেল মোড়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নয়াপল্টনে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে, কারণ আমাদের কিছু ইন্টেলিজেন্স আছে যে, এখানে নাশকতা হতে পারে। যদিও আমরা আশা করছি সেটা হবে না। কিছু গোয়েন্দা রিপোর্ট থাকে, তবে যদি অনুষ্ঠানটা (বিএনপির সমাবেশ) শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়, এসব নিরাপত্তা বলয় উঠে যাবে। ঢাকা শহর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে। সমাবেশের পর পল্টন এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এভাবে সব সময় থাকবে না।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরের পুরোটায় যানবাহন চলছে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেন কোনো ঘটনা না ঘটে। তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি নির্ধারিত এ প্রোগ্রাম শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হোক। সমাবেশ শেষে বিএনপির কর্মীরা ঘরে যাওয়া পর্যন্ত নয়াপল্টনসহ পুরো রাজধানী এমন নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকবে।
মুগদায় ধাওয়া-পালটাধাওয়া : এদিকে সমাবেশস্থলের কাছে মুগদা হাসপাতালের সামনে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, ধাওয়া-পালটাধাওয়া নয়, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা করেছে। সমাবেশের জনসে াতে বাধা সৃষ্টির জন্য তারা এ হামলা করে। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, মুগদা হাসপাতাল এলাকায় ছাত্রলীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। ঘটনাস্থলে সবুজবাগ এবং মুগদা থানার পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছেন।
নিরাপত্তায় ডিবি : শনিবার দুপুরে সমাবেশের কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে আসেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশিদ। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিএনপির সমাবেশ সুন্দরভাবে শেষ করতে কাজ করছে পুলিশ। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল সমাবেশ হয় কিনা বা কোনো বিশৃঙ্খলা হয় কিনা। তবে আজ মানুষ বিশ্বাস করছে শান্তিপূর্ণভাবেই হচ্ছে বিএনপির সমাবেশ। কোথাও আইনশৃঙ্খলার কোনো অবনতি হয়নি, সব স্বাভাবিক। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছে। কোনো আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আজ নেই।
তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে, যাতে বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ সম্পন্ন করতে পারে। সেই লক্ষ্যেই পুলিশ কাজ করছে। যার কারণে এখনো ঢাকায় কোনো ঝামেলা হয়নি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়নি। সমাবেশস্থলেও ঘটেনি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা।
রাজধানীর চেকপোস্টগুলোতে বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানির প্রসঙ্গে হারুন বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে না। চেকপোস্ট পরিচালনা নিরাপত্তার স্বার্থে, পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক।
পুলিশের তল্লাশি : এদিকে সমাবেশ ঘিরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, গাবতলী, উত্তরাসহ প্রবেশপথগুলোতে ছিল পুলিশের কড়া নজরদারি। শুক্রবার রাত থেকেই বাড়ানো হয় তদারকি। যাত্রীবাহী বাস বা মোটরসাইকেল দেখলেই গতিরোধ করে তল্লাশি করেন তারা। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার পাশাপাশি মোবাইল ফোন নিয়ে মেসেজ, কললিস্ট, ছবির গ্যালারি, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের চ্যাট এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করতে থাকেন তারা। এ নিয়ে আপত্তি জানালে অনেকের সঙ্গে অসদাচরণেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়, ছাত্রলীগসহ সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাও সাধারণ মানুষের মোবাইল তল্লাশি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এভাবে এক ডজনের বেশি ব্যক্তি আটকেরও খবর পাওয়া গেছে। তবে ছাত্রলীগের তল্লাশির বিষয়ে পুলিশের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
র্যাবের তৎপরতা : র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নিরাপত্তা জোরদারে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশস্থলের ওপর র্যাবের হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নজরদারি করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদারে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে ছিল তারা। এছাড়া অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে সাধারাণ মানুষকে যাতে কেউ বিভ্রান্ত করতে না পারে সেজন্য সার্বক্ষণিক সাইবার নজরদারি অব্যাহত ছিল।
পুলিশের আশা, নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরে যাবে : এদিকে সমাবেশ শেষে বিএনপিকর্মীরা ঘরে ফিরে যাবে বলে আশা করছে পুলিশ। তা না করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা কঠোরভাবে দমনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। ডিএমপি কর্মকর্তা বিপ্লব বলেন, পুলিশ সদস্যদের আঘাত করা হয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সেজন্যই সারা ঢাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
রাজধানীতে কত সংখ্যক পুলিশ এখন মোতায়েন আছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন আছে। নয়াপল্টন এলাকায় তিন-চারশ পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশনা আছে কিনা-জানতে চাইলে বিপ্লব সরকার বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, শনিবার সকাল ১১টায় সায়েদাবাদের কাছে গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশ শুরু হয়। তার আগে রাত থেকেই বিএনপিকর্মীরা সেখানে জড়ো হতে শুরু করে। বিএনপি এই সমাবেশটি নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সেখানে তাদের অনুমতি দেয়নি। এর মধ্যে নয়াপল্টনে জড়ো হওয়া বিএনপিকর্মীদের ওপর বুধবার চড়াও হয় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহত হন একজন। এরপর পুলিশ কার্যালয়ে ঢুকে বিএনপির তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে, পরে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে।