ড: জাফর ইকবালের উপর হামলা করে হামলাকারীরা কী অর্জন করতে চেয়েছে ? 

ড: জাফর ইকবালের উপর হামলা করে হামলাকারীরা কী অর্জন করতে চেয়েছে ?
============================================
কলমের জবাব কলম দিয়ে দিতে হয় , কথার জবাব কথা দিয়ে । এর পরিবর্তে একজন লেখক বা বক্তার বিরুদ্ধে যা করা হয় – গালি-গালাজ , মামলা ,হামলা , খুন, গুম সবই কাপুরুষতা । এই জঘন্য কাজটি যেমন স্টেইট বা সরকার করতে পারে তেমনি কিছু নন-স্টেইট ইলেমেন্ট বা ব্যক্তিও এই বর্বর কাজটি করে থাকে । শুধু ভিন্ন মতাবলম্বী নয় , কখনো কখনো রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নিজ মতাবলম্বীকেও বিয়োগের খাতায় ফেলে দেয় । প্রকৃত কালপ্রিটকে চিহ্নিত বা পাকড়াও করার জন্যে এই সব সকল দিককেই আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে । জনগণের সচেতনতার উত্তাপ টের পেলেই এরা পিছু হটবে।তা না হলে একের পর এক এই ধরণের কাজ করতেই থাকবে।

ড: জাফর ইকবালের উপর এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং কালপ্রিট যে দল বা বিশ্বাসের হোক না কেন – তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছি । এটুকু করতে ব্যর্থ হলে আমরা নিশ্চিত ভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হবো । বাইরের কোনো অপ-শক্তিও মনে করবে এই জাতিকে কানাঅলা ধরেছে । তখন আমাদেরকে নিয়ে আরো বড় খেলা খেলবে ।

জাতির সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখতে পাচ্ছি । তা থেকে ফেরানোর নিমিত্তেই এই কথাগুলো লিখছি । বিশেষ কোনো গোষ্ঠিকে টার্গেট করা উদ্দেশ্য নয় । আমার এই লেখা বা পর্যবেক্ষণের সাথে অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন । যারা ভিন্নমত পোষণ করবেন তারাও নিজের যুক্তি পেশ করতে পারেন । কারণ সকলের স্বার্থেই সত্যের মুখামুখি আমাদেরকে হতেই হবে । এর কোনো বিকল্প নেই ।

ড: জাফর ইকবালের উপর এই বর্বোরোচিত হামলা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসেছে । ডক্টর জাফর ইকবাল উগ্র জঙ্গীবাদী কর্তৃক অনেক আগে থেকেই হুমকি পেয়ে আসছেন । তাঁকে কাফনের কাপড় পাঠিয়েও হুমকি দেওয়া হয়েছে । তজ্জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর জন্যে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে । সেই সব উগ্র জঙ্গীবাদীদের ছায়া বোঝা গেলেও এদের প্রকৃত পরিচয় জানা যায় নি । এই জঙ্গীদের পেছনে কারা , তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ।
ডক্টর জাফর ইকবাল যে কয়বার প্রকাশ্য হামলা বা কনফ্লিক্টের সম্মুখীন হয়েছেন তাতে প্রতিবারই বর্তমান সরকার দলীয় ছাত্র বা কৃষকলীগের নাম সামনে এসেছে । একবার সস্ত্রীক ছাত্রলীগ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে মনের দু:খে বৃষ্টিতে ভিজে এর প্রতিবাদও জানিয়েছেন । স্থানীয় আওয়ামী নেতৃত্বের সাথে তার কনফ্লিক্টও জাতীয় পত্র পত্রিকায় এসেছে এবং তা নিয়ে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে ।

সর্বশেষ হামলাকারীদের একজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ ও ছাত্রদের হাতে ধরা খেয়েছে । ধৃত ঐ হামলাকারীর পরিচয়ও শনাক্ত করা গেছে । দৈনিক প্রথম আলো জানিয়েছে যে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমানের শেখপাড়ার বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেখান থেকে ধৃত হামলাকারীর মামা সুনামগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহবায়ক ফজলুর রহমানকে আটক করা হয়েছে।
এর পরেও আওয়ামী গোলন্দাজ মোহাম্মদ এ আরাফাত এই হামলার জন্যে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকেই দায়ী করে ফেইস বুকে পোষ্ট দিয়েছেন । এই হামলাকারী অগত্যা ধরা না পড়লে এবং এভাবে শনাক্ত না হলে এই আরাফাতগণ কী করতেন , তা সহজেই অনুমেয় ।
এদিকে ড. জাফর ইকবালের হামলাকারীরা জামাত-শিবিরের দোসর বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ৷ শনিবার রাতে জাফর ইকবালের উপর হামলার প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন ৷

ঘটনাটি এমন সময় ঘটেছে যখন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতার নিয়ে সরকার প্রচন্ড চাপের মুখে পড়েছে । জাতিসংঘ সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এটা নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে । দেশের ভেতরে বাইরে এবং সোশাল মিডিয়ায় সরকারের প্রচন্ড সমালোচনা শুরু হয়েছে । জনগণ সরকারের শিখিয়ে দেয়া “ এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার গল্প নিয়ে ছি-ছি না করে সরকারের লুটেরা বাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা নিয়ে আরো বেশি বলাবলি শুরু করে দিয়েছে । এই মামলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটুকু জনগণের কাছে পানির মত পরিস্কার হয়ে পড়েছে ।

সরকার বিএনপির পক্ষ থেকে যেরূপ প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল বিএনপিও সেই সহিংস আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয় নি । ফলে সরকারের পুরো পরিকল্পনা বলতে গেলে একদম মাঠে মারা গেছে । অনেক কিছুই হিতে বিপরীত হয়ে পড়েছে । দেশের মানুষ সুয়ো রাণী ও দুয়ো রাণীকে চিনতে পেরেছে । এর ফলে বেগম জিয়া ‘ম্যাডাম’ থেকে ‘মা’ তে পরিণত হয়েছেন ।এর রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।
কোনো কোনো নেতার নাম ধরে হাছান মাহমুদদের প্ররোচনামূলক উস্কানি সত্ত্বেও বিএনপির ঐক্য আরো সুদৃঢ় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে । হাছান মাহমুদদের চিকনা বুদ্ধির কথার আড়ালে তাদের হতাশার সুরটিই যেন বেশি বেজে উঠে ।
এমতাবস্থায় এই ইস্যুকে চাপা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে । দেখা গেছে এই সরকারের জন্যে যখনই কিছু চাপা দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে , তখনই জঙ্গিরা কোথাও না কোথাও কিছু করে বসে । আরও মজার কথা হলো , যে হামলাকারী ধরা পড়ে তাদের বিএনপি – জামায়াত সম্পৃক্ততার চেয়ে আওয়ামীলীগ সম্পৃক্ততা জনগণের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে পড়ে ।

আমেরিকার নিরাপত্তা উপদেষ্টা লিসা কার্টিজ এখন ঢাকায় । সেও কিছু না দেখে খালি চোখে ফিরে যাবে তা কেমন করে হয় ?

জাফর ইকবাল স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির পক্ষেই লিখে থাকেন । তবে তাঁর গত লেখাটি লিখেছেন সরকার প্রধানের প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত বহুল আলোচিত একটি উক্তি নিয়ে । সেখানে কিছু মারাত্মক মন্তব্যও আছে । ‘ আর কতদিন এই ভাঙা রেকর্ড ? ‘ শিরোনামের ঐ লেখাটিতে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন ,  “ এখানে একটা কৌতূহলের বিষয় বলা যায়। আমি জানতে পেরেছি বেশ কিছুদিন আগে একটা সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে বিজি প্রেসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায় সম্পত্তির খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছিল। বিজি প্রেস হচ্ছে সেই প্রেস যেখানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ইত্যাদি গোপন কাগজপত্র ছাপানো হয়। এই প্রেসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায় সম্পত্তি বা ব্যাংক ব্যালেন্সের খোঁজখবর নেওয়ার উদ্দেশ্য খুবই সহজ, কেউ হঠাৎ করে তাড়াতাড়ি বড় লোক হয়ে যাচ্ছে কী-না, হঠাৎ করে কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে কী-না সেটি খুঁজে বের করা। যদি এ রকম কিছু দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে ‘ডালমে কুছ কালা হায়।’তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই অত্যন্ত সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় তদন্তটি হঠাৎ করে ‘ওপরের’ আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই বিজি প্রেসের কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী অসৎ উপায়ে বড়লোক হতে শুরু করেছে কী-না সেটি জানার আর কোনও উপায় থাকল না। আমি যেটা জানতে পেরেছি তার মাঝে কতটুকু সত্যতা আছে জানা দরকার। কারণ এটি যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে। ‘ওপরের’ আদেশটি কত ওপর থেকে এসেছে আমি সেটাও জানতে খুবই আগ্রহী। “

এই জানার আগ্রহ বা আস্পর্ধা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে কত বড় অপরাধ, তা সহজেই অনুমেয় ।তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ ডে নিয়ে সংঘটিত ঘটনাবলীতেও সম্প্রতি তিনি অনেকের বিরক্তির কারণ হয়েছেন বলে জানা গেছে ।

ড: জাফর ইকবালের এই ঘটনা থেকে দেশের চিন্তাশীল অংশের আরো বেশী করে ভাবনার সময় এসেছে । আমরা নিজেদের সরবতায় বা নীরবতায় যে ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করছি , তা কি এখন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে ? লাভ যারই হোক , জীবনটা তো যাবে নিজের ! এরকম রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগে পড়ে গেলে যে কারও জীবন যে কোনো সময় বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে । আমরা যদি এখনও বিবেকের তাড়নায় সাড়া না দেই , সামনে খুবই খারাপ সময় অপেক্ষা করছে ।

সবকিছু নষ্টদের হাতে চলে যাওয়ার আগে আসুন সতর্ক হই। কয়েকজন অসুস্থ্য মানুষের জন্যে সারা জাতি আত্মহত্যার পানে ছুটে যেতে পারে না । এই ভয়াবহ খেলা বন্ধ হোক । প্রকৃত কালপ্রিটরা ধরা পড়ুক ।