১২ মার্চ ২০২৩
নিজস্ব প্রতিনিধি
রাজধানীর উত্তরায় বেসরকারি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা ডাকাতির পর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ৯ কোটি টাকা উদ্ধারের ঘোষণা দেয় ডিবি। পরবর্তীতে একলাফে সেটা নিচে নেমে যায় ৩ কোটির ঘরে। এখন আবার বলা হচ্ছে আরো দুই কোটি উদ্ধার হয়েছে। তুরাগ থানা দাবি করেছিল ৪ ট্রাঙ্ক ডাকাতরা নিয়েছিল। তারা টাকাভর্তি ৩টি ট্রাঙ্ক উদ্ধার করেছে। এখন ঢাকা মহানগর ডিবি প্রধান আওয়ামী পুলিশ কর্মকর্তা হারুণ দাবী করছেন ডাকাতরা গাড়ি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর টাকা ব্যাগে ঢুকিয়েছিল। তাহলে কোনটা সত্য? টাকা ভর্তি ৩টা ট্রাঙ্ক উদ্ধার, নাকি ব্যাগে ভর্তি টাকা উদ্ধার? নিজেদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের মাঝেই টাকা
ডাকাতি এবং উদ্ধারের নাটক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ রোববার দুপুরে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন টাকা ভরা হয় বস্তা ও বাজারের ব্যাগে। এর মধ্যে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে যায় ডাকাতরা। তবে কিছু টাকা ফেলে যাওয়া হয় ব্যাগের অভাবে।
অথচ, ডিবির এই হারুণই ডাকাতির কয়েক ঘন্টা পর ঘোষণা করেছিলেন ৯ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ডাকাতি হওয়ার দিনে (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে এই হারুণই বলেছিলেন, লুট হওয়া টাকার বেশির ভাগই উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় ৯ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে দাবী করেছিলেন তখন তিনি।
যদিও পরবর্তীতে আবার বলা হয়, উদ্ধার করা হয়েছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এখন বলা হচ্ছে শনিবার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে নতুন উদ্ধার করা মোট ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা। এতে মোট ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে এখন দাবি করছেন হারুণ।
ডাকাতির সঙ্গে আসলে কারা জড়িত বা কতটাকা উদ্ধার হয়েছে এবং কতটাকা তারা নিজেরাই আত্মসাতের ব্যবস্থা করেছে সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ, ডিবি তাদের কোন বক্তব্যে টিক থাকতে পারছে না। একেক সময় একেক রকম তথ্য পরিবেশন করছে। আওয়ামী গণমাধ্যম গুলো ডিবির বয়ান প্রচার করে যাচ্ছে মাত্র।
গত বৃহস্পতিবার সকালে এটিএম মেশিনে টাকা রিফিল করতে যাওয়ার পথে ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের (ডিবিবিএল) একটি গাড়ি থেকে ১১ কোটি টাকা ডাকাতি হয়। রাজধানীর তুরাগ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। টাকা পরিবহনের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ‘মানি প্ল্যান্ট’ এর কর্মকর্তারা ৪টি ট্রাঙ্কে টাকা নিয়ে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে সাভার ইপিজেডের দিকে যাচ্ছিলেন।
এর কয়েক ঘণ্টা পর, ডিবি দাবি করেছিল ডাকাতি হওয়া ৩টি ট্রাঙ্ক উদ্ধার করেছে এবং মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ২ পরিচালকসহ ৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে অপরাধের সঙ্গে যোগসূত্র না পাওয়ায় শুক্রবার তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু এখন দাবি করা হচ্ছে তুরাগ থানায় ট্রাঙ্কগুলো খুলে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
পুলিশ এখন ডাকাতির একটি বয়ান তৈরি করেছে। ডাকাতির বিষয়ে তুরাগ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শরিফুল ইসলামের বয়ান অনুযায়ী কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় ডাকাতরা ভাড়া করা মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। দিয়াবাড়ি এলাকায় ডাকাতি করার আগে তারা চালককে জিম্মি করে গাড়ির পেছনে বেঁধে রাখে।
৩০০ ফুট এলাকায় তার বাঁধন খুলে দেওয়া হলে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। এরপর ডাকাতরা একটি ট্রাঙ্ক নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। চালক ও রেন্ট-এ-কার সার্ভিসের একজন পরে পুলিশকে খবর দেয়।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার মানি প্ল্যান্টের পরিচালক (অপারেশন্স) আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
শুক্রবার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৩ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আদালত।
রবিবার আরেকটি বয়ান শোনা যায় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তা হারুণের মুখে। তিনি বলছেন, চারটি ট্রাংকের মধ্যে দুটি ট্রাংকের টাকা ডাকাতরা দুটি চালের বস্তা ও পাঁচটি বাজারের ব্যাগে ভরে। দুটি বস্তা ও চারটি বাজারের ব্যাগে করে টাকা নিয়ে যায় তারা। তবে তারা একটি বাজারের ব্যাগভির্তি টাকা এবং বাকি ট্রাংকগুলো গাড়িতে রেখে পালিয়ে যায়। টাকা নেয়ার ব্যাগ না থাকায় বাকি টাকাগুলো ফেলে যায় তারা।
যদি এটাই হয়ে থাকে তুরাগ থানায় ৩টি ট্রাঙ্ক উদ্ধারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল কেন?
গত ৯ই মার্চ উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের গাড়ি থেকে ছিনতাই হয় ডাচ-বাংলার ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। মাইক্রোবাসটি মিরপুর ডিওএইচএস থেকে আশুলিয়ার দিকে যাচ্ছিল। ওই টাকার বড় অংশ এরই মধ্যে উদ্ধার হয়েছে।
মহানগর ডিবির প্রধান হারুন বলেন, ডাকাত দলের ওই সদস্যরা গত ৮ই মার্চ একটি হাইস মাইক্রোবাস সিলেট যাওয়ার জন্য ভাড়া করে। পরদিন ৯ই মার্চ ভোর সাড়ে ৫টায় ড্রাইভারকে কুর্মিটোলা যাত্রী ছাউনীর সামনে আসতে বলা হয়। গাড়ি আসার পর পেছনে সিট ঠিক করার কথা বলে তারা ড্রাইভারকে পেছনে নিয়ে তার হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। ডাকাতরা গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
তিনি বলেন, গাড়িটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় ওঁৎ পেতে বসে থাকে ডাকাতরা। আগে পাওয়া তথ্যমতে, নির্দিষ্ট নম্বরের গাড়িটিকে অনুসরণ করার জন্য অপেক্ষার এক পর্যায়ে মানি প্ল্যান্টের গাড়িটি আসলে তারা পেছন পেছন অনুসরণ করে।
ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, ডাকাতরা মানি প্ল্যান্টের গাড়িকে একবার সামনে অতিক্রম করে আবার পেছনে চলে যায়। নির্জন জায়গায় যাওয়ার পর এক পর্যায়ে টক্কর লাগিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু করে তারা। এরপর গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা চলে যায়। পরে ডাকাতরা টাকাসহ গাড়ি নিয়ে ৩০০ ফিট এলাকায় যায়। পথে ডাকাতরা তাদের পাঁচজন সঙ্গীকে নামিয়ে দেয়। দুটি ট্রাংক থেকে টাকা বের করে তাদের সঙ্গে থাকা দুটি চালের বস্তা ও পাঁচটি বাজারের ব্যাগ ভর্তি করে তারা। গাড়ির ভেতরেই তারা কাপড় পরিবর্তন করে। টাকা নেয়ার জন্য আর কোনো ব্যাগ না থাকায় বাকি ট্রাংকে তারা টাকা রেখে পালিয়ে যায়। ডিবি ও পুলিশের নিজেদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে টাকা ডাকাতি ও উদ্ধার নিয়ে নাটকীয়তা চলছে।