ডলার সংকট : বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে ডলার ধারণ কমেছে

bonikbarta.net

হাছান আদনান

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩

বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় দুটি কেন্দ্র হলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। আমদানি দায় পরিশোধ ও রফতানি আয় গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশ দুটির ব্যাংকগুলো মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা রাখে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলো। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত এক বছরে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর বিদেশী বা ‘নস্ট্রো’ হিসাবে ডলারের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির সংরক্ষিত নগদ অর্থের স্থিতি ছিল ৬৬৬ কোটি বা ৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এ স্থিতির পরিমাণ ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোয়ও। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির অর্থের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ অর্থের পরিমাণ কমে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির নগদ অর্থ কমেছে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটের বিরূপ প্রভাবই দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ব্যাংক খাতে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণে। দেশ দুটির ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব পালন করে। সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর ডলার কমে যাওয়া বৈদেশিক বাণিজ্যের সক্ষমতা কমে যাওয়ারই নির্দেশ করে।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদও মনে করেন, ‘নস্ট্রো’ হিসাবে ডলার কমে যাওয়ায় দেশের অনেক ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যের সক্ষমতা কমে গেছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বেশি, সেসব দেশের ব্যাংকগুলোর ‘নস্ট্রো’ হিসাবে আমরা বেশি ডলার সংরক্ষণ করি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি ও ডলার সংকটের কারণে দেশের আমদানির ঋণপত্র (এলসি) প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ কারণে ‘নস্ট্রো’ হিসাবে জমা করা ডলারও অনেক কমে গেছে।

মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ জানান, স্বাভাবিক সময়ে নস্ট্রো হিসাবে ডলার রাখতে সেভাবে হিসাব করতে হতো না। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে দেশের প্রায় সব ব্যাংককেই এখন নস্ট্রো হিসাবে ডলার সংরক্ষণের জন্য বারবার অংক কষতে হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, এলসি সমন্বয়ের এক-দু’দিন আগে ‘নস্ট্রো’ হিসাবে ডলার জমা হচ্ছে। নস্ট্রো হিসাবে পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে এলসি দায় সমন্বয়ে বিলম্বের ঘটনাও শুনছি।

‘নস্ট্রো হিসাব’ হলো বৈদেশিক মুদ্রায় দায়-দেনা পরিশোধের জন্য বিদেশের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর চালু করা হিসাব। এ ধরনের হিসাবের মাধ্যমে গ্রাহকের পক্ষ থেকে বিদেশী ব্যাংকের আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়। আবার দেশের রফতানি ও রেমিট্যান্সের আয় এবং বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণও নস্ট্রো হিসাবে যোগ হয়। ডলার সংকটে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই ডলার ধারণ সক্ষমতা দুর্বল হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলো নিজেদের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করতে পারে। কোনো ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে অতিরিক্ত ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দেশের অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রায় এক বছর ধরে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। নিজেদের নস্ট্রো হিসাবে পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আমদানির এলসি দায় এক-দুই মাস পর্যন্ত বিলম্ব হচ্ছে বলে বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের তৈরি করা ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাটিস্টিকস’ প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাত ও স্বল্পমেয়াদি সিকিউরিটিজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জমা সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তির জমা সম্পদও আমলে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে দায় হিসেবে দেখানো ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ অর্থের পরিমাণ বেড়ে ৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির অর্থের পরিমাণ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ অর্থের পরিমাণ নেমে আসে ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে।

যুক্তরাজ্যের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ অর্থের পরিমাণ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে যুক্তরাজ্যের ব্যাংক খাতে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অর্থের পরিমাণ নেমে আসে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারে। এ অর্থের মধ্যে ১১ কোটি ডলার ছিল ব্যক্তির। বাকি ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর।

গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর দেশে ডলারের সংকট আরো তীব্র হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো হিসাবে ডলার ধারণের পরিমাণ আরো কমেছে বলে জানা গেছে। সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণ সক্ষমতা কমে গেছে বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো আগে নস্ট্রো হিসাবে যে পরিমাণ ডলার সংরক্ষণ করতে পারত, সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বিদেশে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর ডলারের পরিমাণ কমেছে। আমদানির নতুন এলসিও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলোর ডলার সংরক্ষণ কমে যাওয়ার পেছনে আমদানি কমারও ভূমিকা আছে।

দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা জানান, নস্ট্রো হিসাবে ডলার সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রভাব আমদানির দায় পরিশোধের ওপর পড়েছে। অনেক সময় আমদানির দায় পরিশোধের দিন দেখা যাচ্ছে, নস্ট্রো হিসাবে পর্যাপ্ত ডলার নেই। এ কারণে ওইসব এলসি ওভারডিউ হয়ে যাচ্ছে।

তবে নস্ট্রো হিসাবে ডলার কমলেও দেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের সক্ষমতা কমেনি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের সক্ষমতা নস্ট্রো হিসাবের ডলার দিয়ে পরিমাপ হয় না। বরং এ সক্ষমতা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের রিজার্ভ সক্ষমতা এখনো শক্তিশালী। এ কারণে ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের সক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রশ্ন আসে না।

মেজবাউল হক জানান, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণ কমে এখন ৯২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক ঋণের ধরনই হলো সব সময় বাড়ে। কিন্তু গত তিন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ কমেছে। ঋণ কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোতে ডলার হোল্ডিং কমতে পারে।