জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ সরবরাহকারী চার বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছে দেনার পরিমাণ ৩৬ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সর্বশেষ বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১১ টাকা) অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। এ বকেয়ার কারণে জ্বালানি তেল আমদানিতে এলসি খুলতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি)। বকেয়া জটিলতার কারণে আমদানীকৃত জ্বালানি তেল খালাসে জাহাজে ফাইন্যান্সিয়াল হোল্ড (অর্থ পরিশোধ না হওয়ায় পণ্য খালাস আটকে দেয়া) আরোপের মতো বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়েছে সংস্থাটিকে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে (১৯তম বৈঠক) জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত (১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত) তথ্য অনুযায়ী, বিপিসির কাছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী চার প্রতিষ্ঠান এবং জেদ্দাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) পাওনা বকেয়ার পরিমাণ ৩৬ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এর মধ্যে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী চার প্রতিষ্ঠান পাবে ২৯ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার। আইটিএফসির ঋণ পরিশোধ বাবদ পাওনা বকেয়ার পরিমাণ ৬ কোটি ২৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ১১ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।
ডলার সংকটের কারণে সময়মতো জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। মূল্য পরিশোধের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গড়ে অতিরিক্ত আরো ১০-১২ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। কয়েক ধাপে এলসির মূল্য পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোর সময় লেগে যাচ্ছে এক-দেড় মাস। এমনকি জ্বালানি তেল আমদানির মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেডের দুটি জাহাজে ফাইন্যান্সিয়াল হোল্ড আরোপের ঘটনাও ঘটেছে। এক্ষেত্রে জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল খালাসে বিলম্বজনিত জরিমানা ধরা হয়েছিল দৈনিক ৩২ হাজার কোটি ডলার। এ খরচও বিপিসিকেই বহন করতে হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের কার্যপত্রে উঠে এসেছে।
দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৬০-৬৫ লাখ টন। এর পুরোটাই আমদানি হয় বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসির মাধ্যমে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় জ্বালানি তেল আমদানি বেড়েছে বিপিসির। গত অর্থবছরে মোট ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার ২৭৩ টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে সংস্থাটি, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় তিন লাখ টন বেশি।
বিপিসি দুটি দেশ থেকে অপরিশোধিত আর আটটি দেশ থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। প্রতি মাসে ১৭-১৮টি পার্সেলের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ টন পরিশোধিত ও এক লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিপিসির চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের কার্যপত্রেও এটিকেই জ্বালানি তেল আমদানি বিঘ্নিত হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সরবরাহকারীদের বকেয়া এখন একটু একটু করে পরিশোধ করা হচ্ছে দাবি করে বিপিসি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে এখন আর কোনো বিঘ্ন নেই।
জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে বিলম্বের কারণে সরবরাহকারীরা একসময় বিপিসিকে পণ্যটির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। এমনকি সরবরাহ কমানোর নজিরও রয়েছে। আমদানিতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থানের জন্য জ্বালানি বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছে বিপিসি। বর্তমানে দেশে পণ্য আমদানিতে ডলারের জোগান সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। তার পরেও যেটুকু ডলার সংস্থান হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন বিপিসি ও জ্বালানিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আমদানি স্বাভাবিক রাখতে বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি নতুন আমদানির জন্য ডলারের প্রয়োজনমাফিক সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা।
তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভিটল এশিয়া পিটিই লিমিটেডের (সিঙ্গাপুর) কাছে বিপিসির বকেয়ার পরিমাণ ২০ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ইউনিপেক সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড (ইউনিপেক) পাবে ৭ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানি পিটি বুমি সিয়াক পুসাকোর (বিএসপি) পাওনা ২ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এছাড়া ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডের (আইওসিএল) পাওনার পরিমাণ ১০ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক—জনতা, অগ্রণী, সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে এসব সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছিল বিপিসি। ডলার সংকটের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটিকে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের বকেয়া আগের মতোই। পরিশোধ করা হচ্ছে, তবে খুবই সীমিত। এলসি জটিলতায় জাহাজ আটকে ছিল বেশকিছু দিন।’
এছাড়া জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে আইটিএফসির রিপেমেন্ট বাবদ বিপিসির আরো ৬ কোটি ২৫ লাখ ৮০ হাজার ডলারের দেনা রয়েছে বিপিসির। সংস্থাটির জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের বড় একটি অংশের সংস্থান হয় দাতা সংস্থার ঋণে। এর মধ্যে বড় একটি অংশের জোগান দেয় আইটিএফসি। কিছুদিন আগেই জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসিকে চলতি অর্থবছরে ১৪০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আইটিএফসি। এ ঋণের অর্থ ব্যবহার করে জ্বালানি তেল আমদানি করার কথা বিপিসির। যদিও সংস্থাটির এ অর্থায়নও বিপিসির বিড়ম্বনাকে আটকাতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের অর্থ পরিশোধ বিলম্বিত হলে সংস্থাটির কাছ থেকেও ভবিষ্যতে প্রয়োজনমতো ঋণ পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।
বিপিসির বকেয়া দেনার এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) ও যুগ্ম সচিব কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বকেয়া দেনার বিষয়টি আমার জানা নেই। এটি বিপিসির অপারেশন্স বিভাগ দেখে।’