ডলার সংকটে দেশের আমদানি সংকুচিত হচ্ছে দুই বছর ধরে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে না পারায় স্থবির হতে বসেছে অনেক শিল্প। টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের প্রভাবেও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এবার ডলার সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। ঋণ না পাওয়ায় দেশের অনেক উদ্যোক্তাই এখন কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় সমৃদ্ধি নয়, বরং সংকোচনের মুখে পড়েছে দেশের বেসরকারি খাত। যদিও দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও কর্মসংস্থানের বড় অংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। এ খাত প্রাণবন্ত থাকলে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধির পথে চলে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়।
দেশের ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন প্রায় ১১ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সুদহারের চেয়েও অনেক নিচে নেমে এসেছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। সর্বশেষ অক্টোবর ও চলতি নভেম্বরে ঋণ প্রবাহের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
ব্যাংক নির্বাহীরা জানান, অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছেন না। এ কারণে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। খেলাপি হওয়ার পথে থাকা ঋণের সঙ্গে নতুন সুদ যুক্ত হচ্ছে। বেসরকারি খাতে যে ঋণ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তার বড় অংশই অনাদায়ী সুদের সৃষ্টি। প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি খাতে নতুন ঋণের প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশের বেশি নয়।
সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। গত বছরের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দর হিসাবে দিলেও প্রতি ডলার ১১১ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। যদিও ঘোষিত দরে দেশের কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২৪-১২৫ টাকাও আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে হিসাবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) প্রতি ডলারের মূল্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। বিনিময় হার নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসিও খুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি কমার হার প্রায় ২৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে আমদানি হচ্ছে তার অর্ধেক। চাহিদা অনুযায়ী মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসে থাকছে।
শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট সব পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তির হার ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ কমে গেছে। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। একই সময়ে এসব পণ্যের এলসি নিষ্পত্তির হারও ১৬ শতাংশের বেশি কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তির হার প্রায় ৩৭ শতাংশ কমেছে।
দেশের একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা বণিক বার্তাকে বলেছেন, কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের অনেক শিল্প গ্রুপই চাহিদার অতিরিক্ত কাঁচামাল দেশে এনেছিলেন। ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমিয়ে দেয়ার পরও স্টককৃত কাঁচামাল দিয়ে শিল্পের উৎপাদন চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরই কাঁচামাল শেষ হয়ে এসেছে। এ কারণে উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে পণ্য উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমও মনে করেন, নানামুখী সংকটের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আসছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সংকটের প্রভাবে সবকিছুর ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এটি ভোক্তাদের জন্য নতুন ক্ষতি ডেকে আনবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ভালো নেই। এ কারণে সংকট থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হবে।’
মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দেশের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার পথ সংকুচিত হয়ে আসছে। বর্তমান বাস্তবতায় প্রত্যেকটা পণ্যের দাম বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো থাকতে হবে। ডলারের প্রবাহ বাড়লে পরিস্থিতি ঠিক থাকবে, না বাড়লে সমস্যা আরো জটিল হবে।’
চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। দেশের বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে সব ধরনের পণ্য বিক্রি কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
অর্থনৈতিক নানা সংকটের মধ্যে যুক্ত হয়েছে দেশের বিরাজমান গ্যাস সংকট। বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুট। যদিও মাত্র ২৫৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। সরবরাহ সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেও পুরোদমে সচল রাখা যাচ্ছে না। গ্যাস সংকটের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের ক্ষতি বেড়ে চলছে।
ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার প্রভাব তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ও মুনাফার ওপরও পড়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত সময়ের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডলারের অবমূল্যায়নের কারণে কোনো কোনো কোম্পানিকে লোকসান গুনতে হয়েছে। অনেক কোম্পানি ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুসারে কাঁচামাল আমদানি করতে পারেনি। অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ব্যয় বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ক্রয়সক্ষমতা সংকুচিত হওয়ায় ভোক্তাদের ভোগ কমে গেছে, এর প্রভাব পড়েছে কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়।
গত দুই বছর বিনিময় হার ওঠানামা বা ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বড় অংকের লোকসান দিচ্ছে সিমেন্ট খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস পিএলসি। এর মধ্যে ২০২২-২৩ হিসাব বছরে ১০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও এর আগের ২০২১-২২ হিসাব বছরে ১০৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে কোম্পানিটির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানিকারকরা প্রতি ডলার ১১১ টাকায় কিনতে পারবেন বলে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা ঘোষিত দরে কোথাও ডলার পাচ্ছি না। যে ডলার ৮৪-৮৫ টাকা দর ধরে পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল, সেটি এখন ১২৪-১২৫ টাকায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিনিময় হারের এ বিপুল ক্ষতি আমরা কোথা থেকে পূরণ করব।’
স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় বাড়ার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (বেক্সিমকো) লিমিটেডের ব্যবসায়। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী ৭০৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা নিট মুনাফা হয়েছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে নিট মুনাফা ছিল ১ হাজার ২৫৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এক বছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা কমেছে ৪৩ শতাংশ। মুনাফা কমার কারণ হিসেবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে রফতানি কমার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমেছে। এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যয় বেড়েছে। তাছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাবও কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে
ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে রানার অটোমোবাইলস পিএলসির ব্যবসার ওপরও। ২০২২-২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ব্যবসা থেকে আয় এর আগের হিসাব বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমে ৬৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট লোকসান হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদক ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির ব্যবসার ক্ষেত্রেও ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতির প্রভাব দেখা গেছে। ২০২২-২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে ৮ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা আয় ছিল কোম্পানিটির। সে হিসেবে গত অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় কমেছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময়ে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা এর আগের হিসাব বছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে ৭৮৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সর্বত্রই সংকট দেখছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সব সময় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বুনিয়াদ নিয়ে গর্ব করতাম। কিন্তু সংকট এতটাই বেড়েছে যে পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিই বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। আমরা দেখছি, সংকটের প্রভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এ কারণে খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কোনো গ্রাহক খেলাপি হয়ে গেলে তাকে নতুন ঋণ দেয়াও সম্ভব হবে না। ডলার সংকটের পাশাপাশি ব্যাংক খাত এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। আগামীতে এ সংকট আরো বাড়বে। জাতীয় নির্বাচনের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে অর্থনীতি আরো বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপির খাতায় আরো অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা যুক্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণ কমানো হচ্ছে। কিছু ব্যাংক খেলাপি হওয়ার যোগ্য এমন ঋণের সীমা বাড়িয়ে নিয়মিত দেখাচ্ছে।
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৭০ শতাংশই চলতি মূলধন কিংবা চলমান ঋণ। এ ধরনের ঋণ নিয়মিত রাখতে হলে আদায়ের পাশাপাশি নতুন ঋণ দিতে হয়। গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করতে না পারলে এ ধরনের ঋণ নিয়মিত রাখা সম্ভব হয় না। সংকটের কারণে ব্যবসায়ীদের বড় অংশ এখনই ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে দেশের ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ গণহারে বাড়তে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’
ডলারের মতোই দেশের ব্যাংক খাতে এখন তীব্র তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর পাশাপাশি সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ টাকা ধার করছে। গত মাসে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধারের পরিমাণ ছিল ১০-১৫ হাজার কোটি টাকা। কোনো কোনো দিন এ ধারের পরিমাণ রেকর্ড ২৬ হাজার কোটি টাকায়ও উন্নীত হয়েছিল। চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধারের চাহিদা আরো তীব্র হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে আনা হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এরপর থেকে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। বিশেষ করে কভিড-সৃষ্ট দুর্যোগের সময় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের ঘরে নেমে আসে। যদিও ওই দুই অর্থবছরে সরকার ঘোষিত প্রায় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হয়েছিল। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ‘গত তিন-চার বছর দেশের বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ ছিল খুবই কম। এ সময়ে বড় কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের চেয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখায় বেশি জোর দিয়েছে। এ কারণে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি একেবারেই থমকে গেছে। তবে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ বের করে নিয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নেয়া ঋণের বড় অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে।’
২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তবে চলতি বছরের জুনে এসে সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। এ পরিবর্তনের ফলে চলতি নভেম্বরে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে জানান এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সুদের হার বাড়লে ব্যবসার খরচ বাড়ে। জিনিসপত্রের দামও বাড়ে। মুনাফা করা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের এ চরিত্র বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। দেশে ডলারের বিনিময় হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে আমদানি খরচও বেড়ে যাচ্ছে।’
বনিক বার্তা