প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভারতকে ট্রানজিট দেওয়াতে কী ক্ষতি হবে? ট্রানজিট তো অলরেডি দেওয়া আছে। ত্রিপুরা থেকে বাস ঢাকা হয়ে কলকাতা যাচ্ছে। সেখানে ক্ষতিটা কী হচ্ছে? বরং আমরা রাস্তার ভাড়া পাচ্ছি। সুবিধা পাচ্ছে দেশের মানুষ। আমরা কিছু অর্থ উপার্জন করছি।’ বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় (বাজেট) অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।
ভারতকে ট্রনিজিট দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসামের রুমালীগড় হয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পার্বতীপুরে ডিপোতে তেল আসছে। সেটা নাটোর পর্যন্ত আনব। ক্ষতিটা কী হয়েছে? বরং আমরা তেলটা সস্তায় কিনতে পারছি।
বাংলাদেশ কেন বিচ্ছিন্ন থাকবে
এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভুটান থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত একটি রাস্তা যাচ্ছে। সেই রাস্তাটা যাচ্ছে বাংলাদেশকে বাইপাস করে। বিশ্বব্যাপী রোড হচ্ছে সেটা থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ। কেন বিচ্ছিন্ন থাকব? ভারত চাচ্ছিল এ রাস্তাটা ভুটান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারত ও মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড যাবে। এটা হলে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে কত সুবিধা হতো। সেটাও খালেদা জিয়া নাকচ করে দিয়েছিল। আমরা চারদিকে বন্ধ হয়ে থাকব। এই হলো তাদের (বিএনপির) অবস্থা। তিনি বলেন, নিজেদের দরজা নিজেরা বন্ধ রাখতে পারি না। সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। নেপাল, ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট পাওয়া গেছে ভারতের। এটা একটা দেশ না, আঞ্চলিক ট্রানজিট ও যোগাযোগ সুবিধার জন্য এটা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এত বেশি কথা হচ্ছে তাই এগুলো বলা উচিত।
সংসদ নেতা বলেন, একটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীটা হচ্ছে আজ গ্লোবাল ভিলেজ। একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগাযোগের দরজা বন্ধ করে থাকা যায় না। কি সর্বনাশ করা হয়েছে- এমন আক্ষেপ করে তিনি বলেন, দেশের মিয়ানমারের গ্যাসক্ষেত্রে ভারত, চীন, জাপানের বিনিয়োগ ছিল, ওই গ্যাসটা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত নিয়ে যাবে, নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা একটা ভাগ নেব। এটা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাসের কোনো অভাব হতো না। খালেদা জিয়া সেটা হতে দেয়নি। কেন দেয়নি? আজকে সেই গ্যাস নিয়ে গেছে চীন। আর কোনো দেশ তো নিতে পারছে না। অথচ আমরা সেটা থেকে গ্যাস পেতাম। আমি সরকারে আসার পর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। একটু গ্যাস আনতে পারি কিনা? কিন্তু পারলাম না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে প্রতিটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেখানে ট্রানজিটের ব্যবস্থা। নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ কেনা শুরু করছি। গ্রিড লাইন করা.. আমরা সেই চুক্তিও করেছি এবং কার্যকরও করছি। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে বন্ধ হওয়া রেললাইন, সড়ক ও নৌপথ বন্ধ ছিল। আমরা সেগুলো চালু করে দিচ্ছি।
খালেদা-এরশাদ-জিয়া দেশ বিক্রি করেছে
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমি দেখতি পাচ্ছি কিছু লোক আমার ভারত সফর নিয়ে নানা রকম কথা তুলেছে। ১৯৮১ সালে ছয় বছর পরে দেশে ফিরে আসার পর তখন এই একই কথা শুনতে হয়েছে (ভারতের কাছে দেশ বিক্রি)। এখন জানি না এখন কেন সেই ভাঙা রেকর্ড বাজাতে শুরু করল।
তিনি বলেন, গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলে ভোট বেশি পেলেও ২০০১ সালে সিট বেশি পাইনি। এজন্য সরকার গঠন করতে পারলাম না। কারণ আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি। তো দেশকে বিক্রিটা করে কে? করে গেছে তো খালেদা জিয়া, এরশাদ, জিয়াউর রহমান। এরাই করে গেছে, আওয়ামী লীগ করে না।
তিনি বলেন, আমাদের বাজারটাকে ভারতীয় পণ্যের বাজারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান, ৪০টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার দিয়ে দেয়। ১৯৮০ সালে গ্যাস বিক্রির চুক্তিও করে আসে। ১৯৯২ সালে ভারত গেল খালেদা জিয়া। সেখানে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকহারে ভারতে অনুপ্রবেশ করার কথা স্বীকার করে নেন। তারপরে পুশইন শুরু হয়েছিল। সেখানে আমাদের বহু মানুষ কষ্ট পেয়েছিল। এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের জন্য আমরা সংসদে দাবিও করেছিলাম কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি।
এ সময় সরকারপ্রধান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়কার ভারত সফরে দেশের জন্য কোনো কিছুই আনতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে এসব সরকারগুলোর কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরে ভারত-বাংলাদেশের ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, তিনবিঘা করিডোর উন্মুক্তসহ বিভিন্ন অর্জনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও জিয়াউর রহমান কেউ তো এ সমাধানটা করতে পারেনি, করেনি। জেনারেল এরশাদও ভারতে গিয়েছিল। কি এনেছিল বাংলাদেশের জন্য? কিছুই না। পারলে সব দিয়ে আসে। হাঁটু ধরে বসেছিল।
শেষ হল দ্বাদশ সংসদের তৃতীয় (বাজেট) অধিবেশন
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরের বক্তব্য শেষে রাত ৯টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশন শেষ করতে রাষ্ট্রপতির আদেশ পড়ে শোনান। ৫ জুন সংসদের (বাজেট) অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে ১৯ কার্যদিবসে মোট সাতটি বিল পাস হয়। এছাড়া পাস হয় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট।
৬ জুন সংসদের বৈঠকে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পুরো অধিবেশনজুড়ে বাজেটের ওপর আলোচনা করেন সদস্যরা। ২২৮ জন সংসদ সদস্য ৩৮ ঘন্টা ২৫ মিনিট বাজেটর ওপর আলোচনা করেন। এর মধ্যে সরকারি দলের ১৭২ জন ২৯ ঘণ্টা ১২ মিনিট আলোচনা করেন এবং বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা আলোচনা করেন ৯ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। এই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেওয়ার জন্য ১১৭টি প্রশ্ন জমা পড়লেও তিনি ৬৭টি প্রশ্নের উত্তর দেন। অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের কাছে দুই হাজার ৩০০টি প্রশ্ন জমা পড়ে। তাঁরা এক হাজার ৫২২টি প্রশ্নের উত্তর দেন। এছাড়া ৭১ বিধিতে জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মনেযোগ আকর্ষণের নোটিশ জমা পড়ে ১০৫টি। যদিও একটি নোটিশও আলোচিত বা গৃহীত হয়নি।
samakal