টালমাটাল আবাসন খাত: নির্মাণ সামগ্রীর আকাশ ছোঁয়া দাম

logo

এমএম মাসুদ

২৮ আগস্ট ২০২২, রবিবার

ডলার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন করে আবারো রড, সিমেন্টসহ প্রায় সব ধরনের আবাসন খাত সংশ্লিষ্ট নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। কিছুদিন আগে এক টন রডের দাম ছিল ৮৬ থেকে ৮৭ হাজার টাকা। বাজার ভেদে বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। সিমেন্টের প্রতি বস্তায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে সাড়ে ৫শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে গভীর সংকটের  মুখে পড়েছে দেশের আবাসন খাত।  সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম আগে থেকেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে আরেক দফা নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাট কেনা এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।  আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, এমনিতেই আবাসন খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। এর মধ্যে নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কয়েক মাস আগের হিসেবেই প্রতি বর্গফুটে কমপক্ষে ৫০০ টাকা নির্মাণ খরচ বেড়েছে।

 

নতুন করে আবার নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়াতে হবে। তাদের মতে, রডের প্রধান কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। যে কারণে ডলারের দর শক্তিশালী হলে রডের বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়ে। এক বছরে রডের দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এতবেশি রডের দাম আর কখনই বাড়েনি। নির্মাণের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় রডের পেছনে। যে কারণে পণ্যটির দাম বাড়লে এই শিল্পে খরচ বেড়ে যায়। রডের দাম বেড়ে রেকর্ড: ভবন নির্মাণের প্রধান কাঁচামাল রডের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। গত বৃহস্পতিবার মিল গেটে প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের এমএস (মাইল্ড স্টিল) রড বিক্রি হয় ৯০ হাজার থেকে ৯৩ হাজার টাকায়, যা গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৫ হাজার টাকা বেশি। অটো অথবা সেমি-অটো মিলে উৎপাদিত ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দামও প্রতি টনে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় দেড় বছর টানা বেড়ে চলতি বছরের মার্চে ৭৫ গ্রেডের এমএস রডের দাম ঠেকে টনপ্রতি ৯২ হাজার টাকায়। এপ্রিল মাস থেকে কমে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রডের দাম নেমেছিল টনপ্রতি ৮২-৮৪ হাজার টাকায়। অবশ্য ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অন্যতম এই কাঁচামালের দাম ৫৫ হাজার টাকার আশপাশেই ওঠানামা করছিল। এদিকে খুচরা বাজারে কিছুদিন আগে এক টন রডের দাম ছিল ৮৬ থেকে ৮৭ হাজার টাকা। বাজার ভেদে বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়।

অথচ গত বছর ডিসেম্বরে প্রতি টন রড ৭৫ হাজার থেকে ৭৮ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশ স্টিল মিলস ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাসাদুল আলম বলেন, ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, লোডশেডিং ও গ্যাস সরবরাহসহ নানামুখী সমস্যার কারণে রডের বাজার অস্থির। পরিস্থিতি অনুকূল না হলে রডের বাজার সহসাই সহনীয় হবে না।  সিমেন্টের বাজার উত্তপ্ত: রডের মতো সিমেন্টের বাজারও উত্তপ্ত। গত ডিসেম্বরে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৪০০-৪৫০ টাকা। গত সপ্তাহে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে কোম্পানি ভেদে ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা।  সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির জানান, সিমেন্ট খাত এখন ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। বিশ্ববাজারে কাঁচামাল, পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বাড়তি জ্বালানি খরচ। এতসব সংকটের মধ্যে পড়ে লোকসান কমাতে সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর কেউ কেউ প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। লোকসান কমাতে মূল্য সমন্বয়ের বিকল্প কোম্পানিগুলোর সামনে নেই। এ ছাড়া ভবন নির্মাণের প্রধান উপকরণ হচ্ছে পাথর, বালু, ইট ইত্যাদি। প্রতি ঘনফুট ৮ টাকা দরের বালুর দাম হয়েছে ৩০ টাকা, বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ। প্রতি বর্গফুট পাথর ১৬০ থেকে বেড়ে এখন ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় ৬-৮ টাকা দামের ইট ১০-১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬৬ শতাংশ।  এদিকে ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত পিভিসি ও ইউপিভিসি পাইপ-ফিটিংস, দরজা, সিলিং ইত্যাদি পণ্যের দামও গত কয়েক মাসে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০২০ সালে প্রতি বর্গফুট থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম ছিল ২৫০ টাকা, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৪২০ টাকার বেশি। গ্রিল ও রেলিংয়ের দাম প্রতি বর্গফুট প্রায় ৪৩ শতাংশ বেড়ে ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। স্যানিটেশনে ব্যয় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।  রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) আগামী দিনে আবাসন খাতে আরও বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা করছে। রিহ্যাব সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর লালমাটিয়ায় গত বছর যে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুটে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার ছিল, চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। গত বছর ধানমণ্ডিতে গড় দাম ছিল ১৮ হাজার টাকা বর্গফুট। বর্তমানে প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকার বেশি। মিরপুরেও যে ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুট ৫ হাজার টাকার কিছুটা নিচে ছিল, সেগুলো এখন ৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মধ্যবিত্তদের জন্য যে ফ্ল্যাট কিছুদিন আগেও ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকায় পাওয়া যেতো, তা এখন ৮০ লাখ থেকে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।  রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, আবাসন খাত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে।

প্রতি বর্গফুটে কমপক্ষে ৫০০ টাকা নির্মাণ খরচ বেড়েছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় সামনে আরও দাম বাড়াতে হতে পারে। দাম না বাড়ালে লোকসানে পড়তে হবে কোম্পানিগুলোকে।  উদ্যোক্তাদেও সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছরের আগে যারা প্রকল্প শুরু করেছেন তারা এখন বিপদে পড়েছেন। কারণ চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লেও ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করতে পারছেন না। তবে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলে বাজারে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে ভাবছে রিহ্যাব। অন্যদিকে বাড়তি দাম সমন্বয় করতে না পারায় অনেক আবাসন ব্যবসায়ী পড়েছেন বিপাকে। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলারও চিন্তা করছেন। একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবীর বলেন, এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মূলত আমার এলাকায় জমি-মালিকদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প হাতে নেই এবং নির্ধারিত দামে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই তা বিক্রি হয়।

ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি থাকায় এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লেও ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানো যায় না। আবার যেসব ফ্ল্যাট অবিক্রিত থাকে, সেগুলোর দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাও পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প হাতে নেই। রিহ্যাব প্রথম সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে আবাসন ব্যবসায়ীরাও ব্যাপক চাপের মুখে পড়ছে। নির্মাণ উপকরণের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি, পরিবহন খরচও সমানতালে বেড়েছে। গত কয়েক মাসে নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। সে কারণে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দামও বাড়াতে হয়েছে। হঠাৎ করে ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারা একটু ধীরে চলা নীতি নিয়েছেন। তাতে ব্যবসায় কিছুটা ধাক্কা লেগেছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশে দাম যৌক্তিক হারে বাড়ছে কিনা, সেটি দেখার কেউ নেই। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় ভবন নির্মাণ ব্যয় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে ফ্ল্যাট মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। আবাসনের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে না।