টানা ১২ মাস ঋণাত্মক আমদানি প্রবৃদ্ধি

 দেশে গত বছরের শুরু থেকে ডলার সংকট দেখা হয়। তা সামাল দিতে গত অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমদানিতে তাৎক্ষণিক এর প্রভাব দেখা যায়নি। এতে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইতিবাচক ছিল আমদানি প্রবৃদ্ধি। যদিও তা ছিল নিন্মমুখী।

আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের সরাসরি প্রভাব শুরু হয় মূলত গত বছরের অক্টোবর থেকে। সেই মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। এরপর থেকে আর ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারেনি আমদানির প্রবৃদ্ধি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ১২ মাস ধরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি চলছে আমদানিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের (২০২১-২২) অর্থবছরের চেয়ে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। ওই বছরের প্রথম মাসে আমদানি হয়েছিল ৫ দশমিক ১৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর পরের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ক্রমেই হ্রাস। এর মধ্যে আগস্টে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয় ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ওই দুই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার ও ৭ দশমিক ১৯২ বিলিয়ন ডলার।

গত অর্থবছরের অক্টোবরে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ছয় দশমিক ৪১ শতাংশ ঋণাত্মক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবরে আমদানি হয়েছিল ৭ দশমিক ১১১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় তা কমে হয় ৬ দশমিক ৬৫৫ বিলিয়ন ডলার। সে অনুযায়ী আমদানি কমেছে ৪৫৬ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর নভেম্বরে আমদানি প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক ধারা কিছুটা হ্রাস পায়। ওই মাসে আমদানি হয় ৭ দশমিক ৫৯২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬৩ মিলিয়ন ডলার বা ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম।

ডিসেম্বর থেকে আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে (ডাবল ডিজিট) পৌঁছায়। ওই মাসে দেশে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ০৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৩৯৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৮ দশমিক ৪৩৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

গত অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারা ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই প্রান্তিকে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি ধস নামে। মূলত সেই সময় ডলার সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলায় নানা রকম তদারকি শুরু করে। বেশকিছু এলসি খোলার আবেদন প্রত্যাখ্যানও করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি ও মার্চে আমদানি হয় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৩৭২ বিলিয়ন ডলার, ৪ দশমিক ৬২৪ বিলিয়ন এবং ৬ দশমিক ০৮৫ বিলিয়ন ডলার। ওই মাসে অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি কম হয় যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ৪৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২১ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আমদানি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩২৭ বিলিয়ন ডলার, ৮ দশমিক ৩২৫ বিলিয়ন এবং ৭ দশমিক ৭২৫ বিলিয়ন ডলার।

জানা যায়, ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া ও এলসি খোলায় ব্যাংকগুলোর গড়িমসির কারণে গত অর্থবছরের শেষে প্রান্তিকেও আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে আমদানি হয় ৫ দশমিক ২২৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য; যা তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৪৯৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। ওই অর্থবছরের এপ্রিলে আমদানি হয় ৭ দশমিক ৭২১ বিলিয়ন ডলার।

পরের দুই মাসে (মে ও জুন) আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। ওই দুই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৬৫ বিলিয়ন এবং ৫ দশমিক ০৯৭ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ২৭৬ বিলিয়ন এবং ৭ দশমিক ৬৬৬ বিলিয়ন ডলার।

বিদায়ী অর্থবছরের দেশে মোট পণ্য আমদানি হয় ৭৫ দশমিক ০৬২ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ১০১ বিলিয়ন বা ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের আমদানি হয়েছিল ৮৯ দশমিক ১৬২ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, সেগুলোও ব্যর্থ হয়েছে। এতে সংকট আরও গভীর হয়েছে, যার প্রভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে আমদানি কমেছে  প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর জুলাইয়ে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছর একই সময়ে যা ছিল ৬ দশমিক ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার। পরের মাসে (আগস্ট) আমদানি হয় ৫ দশমিক ২৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ১২৮ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের আগস্টে আমদানি হয়েছিল ৭ দশমিক ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর গত সেপ্টেম্বরে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ২৭৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৯১৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ দশমিক ৬২ শতাংশ কম।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট আমদানি হয়েছে ১৫ দশমিক ৯০৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০ দশমিক ৯০৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাসে আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৯৯৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ।

ব্যবসায়ীরা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে ডলারের সংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে দেশে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। আবার সরকার এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে।

অন্যদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যায়। চলতি বছর থেকে বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তবে বাংলাদেশে ডলার সংকট দূর হচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়েও দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশেই আটকে আছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা সম্প্রসারণ নেই বললেই চলে। কারণ গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে, তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল দুটোরই আমদানি কমে গেছে। এ কারণে আগামীতে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে না, বরং কারখানা বন্ধের ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের দিকে যাচ্ছে।

শেয়ারবিজ