সরকার পতনের একদফা দাবিতে তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার পরিকল্পনা ছিল বিএনপি’র। কিন্তু ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশে হামলার প্রতিবাদে হার্ডলাইনে দলটি। হরতালের পর টানা তিনদিনের অবরোধ পালন করেছে বিরোধী জোট। বিএনপি’র আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে একই কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা ৩৬টি দল। আগামী রোববার থেকে সারা দেশে ফের ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ ডেকেছে বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা দলগুলো। বিএনপি’র একাধিক নেতা জানান, সরকার পূর্বপরিকল্পিতভাবে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে হামলা করে বিএনপিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এরপর বিএনপি’র গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে সরকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ট্যাগ দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সরকারের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি’র প্রতি সাধারণ মানুষের জনসমর্থনের কারণে। ২৯শে অক্টোবর বিএনপি’র হরতাল কর্মসূচিতে নেতারা সেভাবে মাঠে না থাকলেও সারা দেশের সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করেছে। এরপর ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচিও নজিরবিহীনভাবে সারা দেশে পালিত হয়েছে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এটি আন্দোলনে একধরনের বিজয়। তাই চলমান আন্দোলন থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। নেতারা জানিয়েছেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত টানা কর্মসূচি থাকবে। যদি তফসিল ঘোষণা হয় তাহলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে গত বুধবার দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের যেকোনো কৌশলে গ্রেপ্তার এড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলায় জেলায় আরও কঠোরভাবে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি পুরো দেশকে কার্যত অচলের চিন্তা করছে দলটি। কর্মসূচি পালনকালে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য কর্মীদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ওদিকে দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলন কর্মসূচি সরাসরি তদারকি করছেন তারেক রহমান। ভার্চ্যুয়ালি বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। কখনো মাঠের সক্রিয় কর্মীদের সঙ্গে ফোনে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ ছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা মাঠের কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন।
বিএনপি’র নীতি-নির্ধারণী ফোরামের এক নেতা মানবজমিনকে বলেন, গত দুই বছর ধরে সরকারের পতন দাবিতে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করেছে বিএনপি। এতে তিনটি বিষয়ে বিএনপি সাফল্য পেয়েছে। এক নম্বর হলো- এই আন্দোলনে সরকারবিরোধী সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে একত্র করেছে। দুই হলো- বিএনপি’র দাবির পক্ষে গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের সমর্থন বেড়েছে। এর প্রমাণ- বিএনপি’র প্রতিটি সমাবেশে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। যখনই বিএনপি সমাবেশ ডাকে মানুষের স্রোত তৈরি হয়। তিন হলো- বিএনপি’র চলমান আন্দোলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশ অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি’র গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সরকার স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ট্যাগ দিতে চেয়েছিল। এজন্য পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার এখন ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া আর কেউ নেই। তারা বলেন, চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্রের পেশাদারি জনবল ও সাধারণ জনগণ রাজপথে নেমে এসে সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাবে।
গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত: বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসায় অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নেতাদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পরিবারের স্বজন, ব্যক্তিগত সহকারী, গাড়িচালক, কেয়ারটেকারকে। গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঢাকা উত্তর বিএনপি’র সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ডা. জাহিদুল কবির, সিরাজগঞ্জ জেলা ড্যাবের সদস্য সচিব ডা. আতিকুল আলম, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৩৩তম ব্যাচের সাবেক ছাত্র, জাতীয়তাবাদী চিকিৎসক ডা. এমএ আজিজসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতার পর থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। কেউই নিজ বাসায় থাকেন না। শুধু কেন্দ্রীয় নেতা নন জেলা উপজেলা পর্যায়ে বিএনপি’র কর্মীরা গ্রেপ্তার এড়াতে ধানক্ষেতে মশারি টানিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। অনেকে জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত্রি যাপন করছেন।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৪ হাজার ৫শ’ ৫৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা দায়ের হয়েছে ৯৬টি। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪শ’ ৭৬ জন নেতাকর্মী। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের হামলায় মারা গেছেন একজন সাংবাদিকসহ বিএনপি’র ৯ জন নেতাকর্মী।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি’র আর পিছু ফেরার সময় নেই। গ্রেপ্তার করে, হুলিয়া দিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি’র প্রতিটি কর্মীই নেতার ভূমিকা পালন করে এ আন্দোলনে সফলতা আনবে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অটল রয়েছি। দাবি আদায়ে রাজপথে ছিলাম, রাজপথে আছি। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার করে এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না।
মানব জমিন