টাকা, ডলারের তীব্র সংকট, সার আমদানি বাধাগ্রস্ত

টাকা, ডলারের তীব্র সংকট, সার আমদানি বাধাগ্রস্তডলারের তীব্র সংকট, সার আমদানি বাধাগ্রস্ত

সারের ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে গত জুন পর্যন্ত বকেয়া ৮ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে না রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। যথাসময়ে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সরকারি চার ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো ইউরিয়া সার আমদানির নতুন আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খুলতে চাচ্ছে না।

এলসি খুললেও ডলার সংকটের কারণে বিদেশে যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। এতে করে এসব ব্যাংকের এলসির বিপরীতে বিদেশি ব্যাংক নিশ্চয়তা দিতে (অ্যাড কনফারমেশন) রাজি হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমদানির কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে, যা আসন্ন বোরো মৌসুমে কৃষকদের সার সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

সোনালী ব্যাংককে লেখা আলাদা একটি চিঠিতে বিদেশি ব্যাংকের ‘এলসি কনফারমেশন’ নিয়ে জটিলতা নিরসনে বিশেষ অনুরোধ করা হয়। ওই চিঠির অনুলিপিও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে ভর্তুকি বাবদ বকেয়া অর্থ ছাড়ের পাশাপাশি আমদানি ব্যয় মেটাতে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

বিসিআইসি জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিটুজি চুক্তির আওতায় ৯ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন, কাতার থেকে ৩ লাখ টন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টন সার আমদানি করা হবে। এসব দেশ থেকে ইতোমধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। গত নভেম্বরে ও চলতি মাসে দেড় লাখ টন, জানুয়ারিতে ১ লাখ ৮০ হাজার টন, ফেব্রুয়ারিতে দেড় লাখ টন এবং মার্চে ৯ হাজার টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আমদানির মূল্য বাবদ পাঁচ মাসে ৩২ কোটি ৪০ লাখ ডলার প্রয়োজন।

চলতি অর্থবছরে মোট ২৭ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ইউরিয়া সারের চাহিদা ৩ লাখ ১৮ হাজার টন, জানুয়ারিতে চাহিদা ৪ লাখ ২৩ হাজার টন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন এবং মার্চ মাসে চাহিদা ২ লাখ ৪৭ হাজার টন। বিসিআইসি বলছে, চাহিদা বিবেচনায় মৌসুমে সার বিতরণের জন্য জিটুজি উৎসের সারের সরবরাহ অক্ষুণ্ন রাখতে যথাসময়ে এলসি খোলা ও এলসির মূল্য পরিশোধের কোনো বিকল্প নেই। সারের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ভর্তুকির অর্থ জরুরি ভিত্তিতে ছাড় করতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হলেও এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ডলার সংকট গভীর হয়েছে। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপানো কমিয়েছে। এসব কারণেই নগদ অর্থের সংকট বেড়ে গেছে।

এ অবস্থায় সরকারের ব্যয় সাশ্রয় নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কিছু উন্নয়ন প্রকল্প দুই-চার বছর পিছিয়ে গেলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। এ ধরনের কিছু প্রকল্প বাছাই করে বরাদ্দ আপাতত বন্ধ করে হলেও সার আমদানির মতো জরুরি প্রয়োজনে অর্থ ছাড় করা উচিত। এ ছাড়া বর্তমানে সরকার ঋণ পরিশোধের চাপে থাকলেও আপাতত দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সহজ শর্তে আরও বিদেশি ঋণ পাওয়ার বিষয়ে তৎপরতা চালাতে হবে।

ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারছে না বিসিআইসি

সার আমদানির জন্য সরকার বিসিআইসিকে কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। গ্যারান্টির বিপরীতে ব্যাংকগুলো ছয় মাস মেয়াদে এলটিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্টের বিপরীতে ঋণ) সৃষ্টির মাধ্যমে সারের মূল্য পরিশোধ করে। চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী, জনতা, বাংলাদেশ কৃষি এবং অগ্রণী ব্যাংকের অনুকূলে ১৫ হাজার কোটি টাকার কাউন্টার গ্যারান্টি ইস্যু করেছে সরকার। তবে এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে বিসিআইসির ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৬৭ কোটি টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ দায় বা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণগ্রহীতার অনুকূলে নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কারণে ব্যাংকগুলো নতুন করে এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। তারল্য সংকটের কারণে অগ্রণী ব্যাংক সব ধরনের এলসি খুলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। সরকারের কাউন্টার গ্যারান্টির সীমা অতিক্রম করলে কোনো ব্যাংকেই আর এলসি খোলা সম্ভব হবে না। এ কারণে ভর্তুকির বকেয়া টাকা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।

বিসিআইসি জানিয়েছে, গত ২ নভেম্বর সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার টন সারের এলসি খোলার আবেদন করলেও খেলাপি ঋণ থাকায় প্রথমে সাড়া দেয়নি সোনালী ব্যাংক। বারবার যোগাযোগ এবং অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ বিবেচনায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে গত ৯ নভেম্বর এলসি খোলা হয়।

বিদেশি ব্যাংক নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়

ইউরিয়া সারের প্রতিটি এলসির বিপরীতে সরবরাহকারীর চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিদেশি কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে এলসির জন্য অতিরিক্ত নিশ্চয়তা বা অ্যাড কনফারমেশন নিতে হয়। কিন্তু সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত ডলার সংস্থান করতে না পারায় যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তাই বিদেশি ব্যাংকও তাতে রাজি হচ্ছে না।

বিসিআইসি জানায়, গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্লোবের অনুকূলে সোনালী ব্যাংক থেকে এলসি খোলা হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ পাওনা থাকায় তাদের এলসি নিশ্চয়তা দেয়নি বিদেশি মাশরেক ব্যাংক। বিদেশি ব্যাংকের সম্মতি ছাড়া সার সরবরাহের জন্য ফার্টিগ্লোবকে অনুরোধ করা হলেও তারা রাজি হয়নি। একই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বিদেশি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সার আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সার সরবরাহের জন্য নিয়ম অনুযায়ী আগেই জাহাজ ভাড়া করা হয়। কিন্তু এলসি কনফার্ম না হওয়ায় বন্দরে জাহাজ অধিক সময় অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে প্রতিদিন ১৩ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। সার আমদানির ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি বিসিআইসির সঙ্গে পরিবহন ঠিকাদারের মধ্যেও বিরোধ তৈরি হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় যা বলছে

বিসিআইসিকে ভর্তুকির পাওনা কেন দেওয়া হচ্ছে না– জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সাধারণত নির্বাচনের বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরকারের কোষাগারে অর্থের সংকট দেখা দেয়। এবার নির্বাচনের সঙ্গে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতির ওপর চাপ তুলনামূলক বেশি। তাই চাহিদা অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে অর্থ ছাড় করতে দেরি হচ্ছে। তবে সার আমদানি খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিছু প্রক্রিয়া শেষ করে ভর্তুকি বাবদ বিসিআইসির পাওনা ছাড় করা হবে।

সমকাল