জুলাই সনদ নিয়ে টানাপড়েন

logo

স্টাফ রিপোর্টার

৩০ জুলাই ২০২৫, বুধবার

mzamin

facebook sharing button

শেষ মুহূর্তে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। দলগুলোকে ঐকমত্য কমিশন থেকে সরবরাহ করা সনদের খসড়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে কয়েকটি দল। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে খসড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এনসিপি জানিয়েছে সনদের যে খসড়া দেয়া হয়েছে তা তারা গ্রহণ করতে পারছে না। দলটি চায় জুলাই সনদ ঘোষণার পদ্ধতি আগে জানাতে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয় সনদের খসড়াটি অসম্পূর্ণ প্রস্তাবনা। দলটির পক্ষ থেকে জুলাই সনদ চূড়ান্তে দু’টি ভিত্তির কথা বলা হয়েছে। ওদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে চলমান আলোচনা শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যেই একমত, দ্বিমত ও ভিন্নমতগুলো একত্রিত করে তৈরি হবে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। এতে ঐকমত্যের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে, আর দ্বিমতের অংশগুলো ‘নোট অব দ্য ডিসেন্ট’- হিসেবে সন্নিবেশিত হবে। রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাক্ষর করবেন এই সনদে। ৫ই আগস্টের মধ্যে যেকোনো একদিন স্বাক্ষরের জন্য দিন ধার্য করা হতে পারে। কমিশন বলছে, বৃহস্পতিবারের মধ্যে আলোচনা মুলতবি করা হবে।

ওদিকে কমিশনের দ্বিতীয় দফার বৈঠকে একের পর এক ইস্যুতে নিয়ে আলোচনা চললেও এখনও অনেক বিষয়েই দ্বিমত অব্যাহত রয়েছে। সোমবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রেরিত সনদের খসড়া নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিশেষ করে, জুলাই সনদের নতুন বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ থাকলেও তার বাস্তবায়ন ভবিষ্যৎ জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ একাধিক দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সব দল একমত হলেও এর গঠন কাঠামো নিয়ে এখনো চূড়ান্ত ঐক্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। জামায়াতে ইসলামী বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে ৫ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন করা হবে।  সেখানে- সরকারি দল, বিরোধী দল, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেতা থাকবেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গঠন করবেন। যদি তা না হয় তাহলে সরকারি দল, বিরোধী দল ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দল প্রত্যেকে ৫ জন করে নাম প্রস্তাব করবেন। যদি কোনো একজন প্রার্থীর নাম সকলে প্রস্তাব করেন তাহলে উনিই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ হবেন। তা নাহলে কমিটির  ৪ জন সদস্য যদি একজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করেন তাহলে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর যদি তাও না হয় তাহলে, র?্যাংক চয়েস ভোটের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। তবে সেক্ষেত্রে বাছাই কমিটিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ১ জন ও হাইকোর্ট থেকে একজন বিচারপতি যুক্ত হবেন। তাদের ভোটের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবেন। এ বিষয়ে বিএনপি ছাড়া সবাই একমত।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, প্রথম ধাপ ও দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো আজ বা কালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। আমরা ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ করতে চাই। আর ঐকমত্যের বিষয়গুলো সংযুক্ত করে বৃহস্পতিবারের মধ্যে সনদের জায়গায় পৌঁছাতে পারবো আশা করছি।

শেষ মুহূর্তের তৎপরতা: জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে শেষ মুহূর্তের তোড়জোড় চলছে কমিশনে। বিএনপি’র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বেশকিছু বিষয় খসড়ায় স্থান পাচ্ছে। বিএনপি’র অবস্থান, শতভাগ ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, সনদে আইনগত ভিত্তি না থাকলে তারা স্বাক্ষর করবে না। জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, সনদের বাস্তবায়ন করতে হলে গণপরিষদ নির্বাচন দিতে হবে। এছাড়াও দলটি বলছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে ছয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণপদ্ধতির কথা বলা হলেও তা নিয়ে আলোচনা না করেই, হঠাৎ করে জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলো নির্বাচনের আগে একটি আইনি কাঠামোর (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) মাধ্যমে বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্যথায় জুলাই সনদ গ্রহণ করবে না এনসিপি।

১৫ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অগ্রগতি, নির্বাচন কমিশন গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত ঐকমত্য। এখন পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও দু’টি বিষয়ে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’- রয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব মেনে নিলেও তা নির্ধারিত নিয়োগ কমিটির বাইরে গেলে তবেই। আর দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে মৌখিক ঐকমত্য থাকলেও এসব বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদের খসড়া পেয়েছি। তবে আরও পর্যবেক্ষণ করে আগামী ৩১শে জুলাইয়ের পর এ নিয়ে মন্তব্য  করবো।

তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে পেতে সবাই একমত। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে ৫ সদস্যবিশিষ্ট বাছাই কমিটি গঠনেও আমরা একমত। তবে র‌্যাঙ্ক  চয়েসের পক্ষে নয় বিএনপি। বাছাই কমিটির সদস্যরা একমত হতে না পারলে তা পার্লামেন্টের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। এ বিষয়টা আমরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে ঐকমত্যে আসতে পারি। আমরা চাই খুব শিগগিরই জাতীয় সনদ তৈরি হোক।

বিএনপি’র এই নেতা বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ সংক্রান্ত সাংবিধানিক কমিটি গঠনের জন্য কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান আগের মতোই রয়েছে। আমরা চাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের যে বিদ্যমান আইন রয়েছে, সে আইনগুলো আরও কড়াকড়ি আরোপ করি যেন জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে গঠনের জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। যদি কোনো সময়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংশোধন করার প্রয়োজন হয়, তা যেন আইনে থাকা হয় যা সংশোধন করা যাবে। রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গকে দুর্বল করে অন্য অঙ্গকে ক্ষমতা বেশি দিলে ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন হবে না।

আমরা চাই সকল অঙ্গ তার সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে থেকে সমপূর্ণ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করবে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ যেন অন্য অঙ্গের প্রতি হস্তক্ষেপ করবে না।  তবে ৫ সদস্যের বাছাই কমিটি নির্ধারণ করতে পারবেন- এর মাধ্যমেও নির্ধারণ না হলে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে ফিরে যাওয়া যেতে পারে।

জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই সনদের এই খসড়া একটি অসম্পূর্ণ প্রস্তাবনা। ঐকমত্য কমিশনে যে বিষয়গুলো আলোচনা হচ্ছে আমরা একমত হচ্ছি, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার স্পষ্টভাবে কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং যেটা লেখা হয়েছে, সেটা শুধু হতাশাব্যঞ্জক নয়, এটা ডেঞ্জারাস (বিপজ্জনক)। তারা বলছেন, এটা (সনদের খসড়া) একটু মিসটেক (ভুল) হয়েছে। একটি নমুনা তৈরি করতে গিয়ে তারা এটা লিখেছেন, কিন্তু এটাই মূল কথা না। আমরা নিজেরাও একটি ড্রাফট করতেছি, আমরা সেটাও দেবো। যে সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে এর আইনগত ভিত্তি কী হতে পারে- সে ব্যাপারে আমরা একটি স্পষ্ট প্রস্তাব দেবো।

তিনি আরও বলেন, আমরা দু’টি বিষয় গ্রহণ করতে পারি, একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি দেয়া, অন্যটি পরে যারা নির্বাচিত হবে তারা এটার রেক্টিফাই করবেন কমিটমেন্ট নেয়া। আর না হলে এটাকে গণভোটে দেয়া। জনগণই এটার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, ইতিমধ্যে কমিশন যে খসড়া পাঠিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে। আগামীকাল খসড়ার ওপরে আমরা মতামত দেবো। বর্ধিত চ্যার্টার আকারে আজকে দলগুলোকে তারা (কমিশন) দেবেন। ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে আমরা একটা সমঝোতার জায়গায় আসতে পারবো। আগামী ৫ই আগস্টের আগে জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করতে পারবো।

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি সংলাপের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হলে নির্বাচনের আগে সেগুলোকে একটি আইনি কাঠামোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। আসন্ন নির্বাচন অবশ্যই সেই আইনি ভিত্তির ওপর হতে হবে।
জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশের জন্য ঐকমত্য কমিশনের সমালোচনা করে রাসিন বলেন, আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে কখনো আলোচনা হয়নি এবং হঠাৎ করে একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এটি অগ্রহণযোগ্য।

তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী কাঠামো’ ভেঙে ফেলতে অপরিহার্য বিবেচিত মূল সংস্কারগুলো আইনগতভাবে নিশ্চিত করা না হলে, এনসিপি জুলাই সনদে সই করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে। আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত চাই। একতরফাভাবে কিছু চাপিয়ে দেয়ার যেকোনো চেষ্টা মেনে নেয়া হবে না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, জুলাই সনদের খসড়া পড়ে এটাকে পতিত স্বৈরাচারের প্রতি নমনীয়, আইনি বাধ্যবাধকতাহীন দুর্বল সনদ বলে মনে হয়েছে।

তিনি বলেন, খসড়ায় একবারের জন্যও পতিত ফ্যাসিবাদের মূলহোতা ও অশুভ চক্রের প্রধান শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করা হয় নাই, অথচ পুরো ফ্যাসিবাদ তারই নেতৃত্বে নৃশংসতা চালিয়েছে। সামপ্রতিক একাধিক প্রমাণিত ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিতে শোনা গেছে। তারপরেও জুলাই সনদে শেখ হাসিনার নাম না থাকা মেনে নেয়া যায় না। একইসঙ্গে জুলাই সনদে পতিত ফ্যাসিবাদকে গৎবাঁধা শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলে পতিত ফ্যাসিবাদের নির্মমতা, নৃশংসতা ও বিভীষিকাময় দুঃশাসনের চিত্র খসড়া সনদে নাই।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণ-অধিকার পরিষদসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।

অন্যদিকে, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কোনো দলের চিন্তার অনুলিপি হলে তা ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক পোস্টে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here