জুলাই সনদে আরো ছাড় দিতে পারে দলগুলো

logo

বিশেষ সংবাদদাতা
মুদ্রিত সংস্করণ

জুলাই সনদ নিয়ে আজ ৪টার মধ্যে মতামত জমা দানের নির্ধারিত সময় রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে বিভক্তির বিষয়গুলো নিয়ে আরো ছাড় দিতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো, যাতে ঐকমত্য নিয়ে বড় রকমের কোনো অচলাবস্থা তৈরি না হয়। তারা মনে করছেন যেকোনো অচলাবস্থা নির্বাচনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে বিরোধের ইস্যুগুলোতে ঐকমত্যের ভিত্তি দেয়ার জন্য কমিশনের সদস্যরা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অধিকাংশ দল জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন পদ্ধতি দাবি করছে। কিছু বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দল ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সময়সীমার অনুপস্থিতি নিয়ে হতাশা ও সংশোধনের দাবিও করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র, কিন্তু সহযোগিতাপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে সার্বিকভাবে সমর্থনযোগ্য মনে করছে, যদিও খসড়ায় আইনি স্পষ্টতা, সময়সীমার অভাব ও বিভিন্ন প্রস্তাবে ভিন্নমত- এই তিনটি মূল ইস্যু নিয়েই সংশোধন ও আলোচনার দাবি তুলেছে।

মূলত তিনটি জায়গায় মতপার্থক্য রয়েছে- ক্ষমতার কাঠামো (প্রেসিডেনশিয়াল বনাম সংসদীয় মডেল), বাস্তবায়নের আইনগত ভিত্তি (রেফারেন্ডাম, অর্ডিন্যান্স, সাংবিধানিক সংশোধন) ও সময়সীমা ও বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন ধারা। এতে স্পষ্ট যে, সবাই সংস্কার চায়, কিন্তু কোন কাঠামো ও কোন আইনগত রূপে হবে, সেটি নিয়ে দলগুলোর অবস্থান এখনো দূরে দূরে আছে।

বিএনপি সমন্বিত খসড়া গ্রহণযোগ্য মনে করলেও, কিছু অংশে অসামঞ্জস্য ও অপ্রতুলতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। তারা ২০ আগস্ট নাগাদ আনুষ্ঠানিক মতামত দেবে, বিশেষ করে শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনে সমস্যা ও বাস্তবায়নপদ্ধতির অনুপস্থিতি নিয়ে কথা বলবে দলটি।

জামায়াতে ইসলামী খসড়াকে ‘অপরিণত’ বলে অভিহিত করেছে এবং এর বাস্তবায়নে আইন বা রেফারেন্ডামের প্রয়োজনীয়তা তুলে এনেছে। আইনি বাধ্যবাধকতা ও আনুপাতিক নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াত কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করছে। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও কাছাকাছি মত ব্যক্ত করে আনুপাতিক নির্বাচন ছাড়া সনদ মানবে না বলে জানিয়েছে।

জুলাই সনদ নিয়ে সবচেয়ে কঠোর মনোভাব জানিয়েছে এনসিপি। এনসিপি জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দিলেও জুলাই সনদ নিয়ে কোনো ছাড় না দেয়ার কথা জানিয়েছে। এনসিপি বলেছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পর নির্বাচনে যাবে তারা। অন্যদিকে, সিপিবি ‘আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না’ মর্মে অঙ্গীকারনামায় আপত্তি জানিয়েছে ।

১২-দলীয় জোট ২১টি সংস্কার প্রস্তাবে ৯টি বিষয়ে স্বতন্ত্র ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে; জাসদ, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম ইত্যাদি দল ‘রাষ্ট্রের মূলনীতি’ বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে। একইভাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে বিরোধিতা করেছে।

বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লেবার পার্টি ইত্যাদি দল রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর দ্বৈত পদ ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন ইত্যাদি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে।

খসড়ায় ৮ দফা অঙ্গীকারনামা থাকা সত্ত্বেও, বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা এবং প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুপস্থিত থাকায় অনেক দল- বিশেষ করে বিএনপি, এনসিপি হতাশ হয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬ আগস্ট ২০২৫-এ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পুরো খসড়া পাঠিয়েছিল, যাতে রয়েছে খসড়ার ব্যাখ্যা, ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং ৮ দফা অঙ্গীকারনামা। কমিশন দলগুলোকে জানিয়েছিল, ২০ আগস্ট বিকাল ৪টায় এর মধ্যে শব্দচয়ন, ভাষা বা অন্য কোনো বিষয়ে মন্তব্য পাঠাতে।

বিএনপি ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট জানিয়েছে, বাকিগুলোতে ভিন্নমতপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দল আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া না থাকা নিয়ে হতাশা এবং আপত্তি জানিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে যেন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন, রেফারেন্ডাম, এলএফও, প্রভৃতি বিকল্প নিয়ে বাস্তবায়নের উপযোগী কাঠামো তৈরি করা যায়। ২০ আগস্ট (আজ) দলগুলো মতামত জমা দিয়ে যে ধরনের সমন্বয় বা প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত খসড়াকে চূড়ান্ত খসড়ায় রূপান্তর করা হবে।

পূর্ববর্তী খসড়ায় বলা হয়েছিল-পরবর্তী সরকার গঠনের পর ২ বছরের মধ্যে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে; তবে সমালোচনার পর এটি আপাতত কার্যত ছেড়ে দেয়া হয়েছে বা সময়সীমা পুনর্বিবেচনায় রয়েছে।

দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য বনাম ভিন্নমত

ঐকমত্যের জায়গা : আওয়ামী লীগ পতনের পর রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন- এ বিষয়ে সব দল একমত। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদি শক্তিশালী করতে হবে- প্রায় সব দল এটি সমর্থন করছে। বড় দল ও ছোট দল সমানভাবে ক্ষমতায় অংশ নিতে পারবে এমন নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে মর্মে কথায় বিস্তৃত সমর্থন আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমননীতি যেন আর না ঘটে এমন মন্তব্যকে সবাই মৌলিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে মানছে।

ভিন্ন মত : রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশ্নে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি প্রেসিডেনশিয়াল মডেলের কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। সংসদের দুই কক্ষে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন নিয়ে ইসলামী আন্দোলন, বিএনপি, সিপিবির দ্বিমত রয়েছে। “আদালতে চ্যালেঞ্জ নিষিদ্ধ” ধারাকে সিপিবি গণফোরাম, জাসদ গণতন্ত্রবিরোধী বলেছে।

বাস্তবায়ন পদ্ধতি (রেফারেন্ডাম, অর্ডিন্যান্স, এলএফও, সাংবিধানিক সংশোধন) নিয়ে বিএনপির বিপরীতে জামায়াত, এনসিপি আইনি ভিত্তি ছাড়া অকার্যকর হবে বলে মত প্রকাশ করেছে। ইতিহাস মূল্যায়ন ও দায়বদ্ধতা প্রশ্নে শাপলা চত্বর, গুম-খুন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্তি বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে জামায়াত, গণঅধিকার পরিষদ। সময়সীমা (২ বছরের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন) নিয়ে অধিকাংশ দল হতাশা প্রকাশ করেছে; আবার কেউ কেউ মনে করছে সংস্কারের জন্য দুই বছর যথেষ্ট নয়।

উল্লেখ্য, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এসব ব্যাপারে একটি সাধারণ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here