আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের নীতিমালা মেনে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা আগামী ১ জুলাই থেকে প্রকাশ করা হবে। তবে রবিবার (১৮ জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আইএমএফের নীতিমালা মেনে প্রকৃত রিজার্ভ গণনা করা হলেও তা প্রকাশ করা হবে না। গভর্নরের এই ঘোষণায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আবারও অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।
এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ গণনা করে তা প্রকাশ করা উচিত। এতে রিজার্ভের স্বচ্ছতা বাড়বে। তিনি বলেন, আইএমএফের পদ্ধতি অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ বাদ যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অংশটুকু বাদ দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ না করলে তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১ জুলাই থেকে রিজার্ভ নিয়ে কোনও অস্পষ্টতা থাকবে না। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (জিআইআর) গণনা করে তা প্রকাশ করা হবে। আর যেটা প্রকাশ করা হবে না, তা হলো রিজার্ভ নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর)।
এদিকে বুধবার (২১ জুন) মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। হাবিবুর রহমান বলেন, আইএমএফের পদ্ধতি অনুযায়ী ২১ জুন দিন শেষে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার কম অর্থাৎ রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
এর আগে গত ১৮ জুন নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যাংকের দামে ডলার বিক্রি করবে। তখন থেকে ডলারের কেনা ও বেচায় এক দাম চালু হবে। এখন ব্যাংকগুলো ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দামে প্রবাসী আয়, ১০৭ টাকা দামে রফতানি আয় কিনছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের ডলার বিক্রি করছে ১০৬ টাকা দামে।
ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে আইএমএফের পরামর্শে সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতি অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ফর্মুলা মেনে চলবে বাংলাদেশ। এর ফলে দেশের রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর এটি পুরোপুরি মানতে গেলে নিট রিজার্ভ নেমে যাবে ২০ বিলিয়নের ঘরে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি সম্পর্কে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ করবে। অর্থাৎ, আগে যে পদ্ধতিতে করা হতো, সেভাবেও করা হবে, আবার বিপিএম৬ পদ্ধতিতেও করা হবে। তবে আমরা বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য হিসাব করলেও তা প্রকাশ করবো না। পৃথিবীর কোনও দেশ তা প্রকাশ করে না। আইএমএফের এ বিষয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই প্রকাশে।
প্রসঙ্গত, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন মোট রিজার্ভের যে হিসাব প্রকাশ করে আসছিল তা নিয়ে আইএমএফ প্রশ্ন তুলেছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবের মধ্যে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়।
রিজার্ভ হিসাবায়নে আইএমএফের পদ্ধতিই যথাযথ বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, অন্য দেশগুলো অনেক আগে থেকেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। এটাই আন্তর্জাতিক পদ্ধতি।
আইএমএফের ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল, নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা। এক্ষেত্রে মানতে হবে বিপিএম৬ ফর্মুলা। এটি পুরোপুরি মানতে গেলে নিট রিজার্ভ নেমে যাবে ২০ বিলিয়নের ঘরে। কারণ, দেশের প্রকাশ করা রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ছাড়াও এক বছরের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সমপরিমাণ অর্থ বাদ দিলে পাওয়া যাবে নিট রিজার্ভ।
বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার রয়েছে ইডিএফ ও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ। এগুলোসহ মোট রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ করা ৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলার।
গভর্নর বলেন, আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলঙ্কার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।
জানা যায়, রিজার্ভের অর্থে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ও লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) শীর্ষক তহবিল গঠন করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনে (আইটিএফসি) আমানত হিসেবেও রাখা হয়েছে রিজার্ভের অর্থ। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে (এসবিএফএফ) পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমানকে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ঋণ।
প্রসঙ্গত, গত ১১ মে পর্যন্ত হিসাবে এসব জায়গায় রিজার্ভ থেকে খাটানো অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইডিএফে ৪৭৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, জিটিএফে ১৭ কোটি ৬৮ লাখ, এলটিএফএফে ২৭ কোটি ৩৭ লাখ, আইটিএফসিতে আমানত ২৪ কোটি ৭৪ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমানকে ৭৭ কোটি ৫৭ লাখ এবং শ্রীলঙ্কা দেওয়া ঋণ ২০ কোটি ডলার।
আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। সংস্থাটির ভাষায় এগুলো নন-লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। তাই রিজার্ভ থেকে এসব অর্থ বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ দেখানোর পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তার অন্যতম শর্তই রয়েছে বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন।