জাতীয় নির্বাচন : অর্বাচীন উক্তি

২২ মার্চ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচন হয়ে গেল যেখানে শাসক দল আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন ১৫,৯৫৫ ভোট, পক্ষান্তরে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছেন ৮১৭ ভোট। মাত্র ৫.২৬ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন ভোটার হিসেবে ভোট দিয়েছেন। সরকারি দলের প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র আমলা বলেছেন, ‘একটি ভোট পড়লেও নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক।’ বক্তব্য যতই অসঙ্গত বা নোংরা হোক না কেন, ‘প্রভুভক্তি’ দেখানোর জন্য এগুলো বলা চলতেই থাকবে। কিন্তু এসব বক্তব্যের কারণে প্রহসনমূলক নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা যেভাবে ভোট প্রদানে উৎসাহ হারাচ্ছেন, কাণ্ডজ্ঞানহীন আমলারা অযাচিত বক্তব্য রেখে নিরুৎসাহী ভোটারদের ভোট প্রত্যাখ্যানের বিষয়কে একদিকে বরং বৈধতা দিচ্ছেন, অন্য দিকে বক্তব্যগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি খারাপ নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

‘একটি ভোট পড়লেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক’ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদ নিম্নে তুলে ধরা হলো :

অনুচ্ছেদ:-৭। (১) “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।”

অনুচ্ছেদ:- ৬৫। (২) “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।” অনুচ্ছেদ:- ১২২। (১) “প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার ভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।”
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে সর্বদলীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে সংবিধান সংশোধন করে সংযোজিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দাবির অগ্রনায়ক। তারাই ক্ষমতায় বসেই সংবিধান থেকে জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার পদ্ধতিকে বিদায় দিয়েছে। তখনকার সেøাগান “আমার ভোট আমি দিবো, যাকে খুশি তাকে দিবো” পদ্ধতির কফিন কাঁধে বহন করতে করতে ৫-৬ শতাংশ ভোটে এমপি নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হলো।

একজন ভোটার ভোট দিলেও যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় তবে জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ‘নির্বাচন কমিশন’ নামক প্রতিষ্ঠানকে লালন করে জনগণের কী লাভ হচ্ছে? আজ্ঞাবাহক নির্বাচন কমিশনের মূর্খতা এখানেই শেষ নয়। মূখ্য নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা বলেছেন যে, ‘বাড়ী বাড়ী গিয়ে ভোটার আনা আমার দায়িত্ব নয়।’ নির্বাচন কমিশন যদি নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে না পারে তবে এ কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি অফিসিয়াল ব্যাখ্যা থাকা দরকার। নতুবা শপথবাক্য পাঠ করিয়ে উচ্চমূল্যে কমিশনারদের পেছনে ব্যয় না হলে কৃষক, শ্রমিক অর্থাৎ মেহনতি মানুষের ঘাম জড়ানো অর্থ বেঁচে যায়। ভোট কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স এনে ঘুমিয়ে ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সময় কাটানোর জন্য ব্যয়বহুল কমিশনের দরকার হয় না, কেরানি আর চৌকিদার হলেই যথেষ্ট। এতে একদিকে জনগণের অর্থ বেঁচে যাবে, অন্য দিকে ‘কমিশন’ নামক একটি জড়পদার্থের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়া থেকে জনগণ রক্ষা পাবে বৈ কি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ছিল স্বাধিকার আন্দোলন। ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে ব্যর্থ হয়েই বাংলার মানুষ স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাঙালিদের রক্ত দিয়ে হোলি খেলা শুরু করল তখনই শুরু হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং এ প্রতিরোধ থেকেই রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধ। অথচ দুর্ভাগ্য, জাতির ভাগ্যাকাশ থেকে ভোটাধিকার নামক মৌলিক অধিকারও দিনে দিনে বিদায় নিচ্ছে।

Election বা ‘নির্বাচন’ বলতে কী বুঝায়, সে সম্পর্কে The Daily Star পত্রিকায় ১৬/১২/২০০৬ ইং তারিখে প্রকাশিত এবং আমেরিকার রাষ্ট্রদূত লিখিত একটি প্রবন্ধ থেকে একটি ব্যাখ্যা নি¤েœ উল্লেখ করা হলো :- “Election means an election (a) in which all parties participate, (b) whose outcome is broadly accepted as legitimate and accurate, (c) where violence and intimidation do not keep people from voting or expressing their opinion, (d) where minorities are not singled out for persecution, (e) where the playing filed is more or less event & (f) where electoral process meets the international standards of fair play and is consistent with the constitution and other laws of the land.”

“Pablic Elections Law and Practice” বইতে নির্বাচনকে Political Development এবং Political Education হিসেবে উল্লেখ করে নি¤œ বর্ণিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে :-
“Elections contribute to political development and the political education of the people. Regular holding of elections contribute to the process of political development. Conversely the absence of regular elections retard the process of political development.”

“Elections are instruments of political education. They educate the people in their political responsibilities. Elections are among the most significant and most pervasive of the educational acts, and they contribute to the education of those who participate in the election process.”
ওই আর্টিকেলে সংবিধান ও বিভিন্ন সূত্র থেকে উদ্ধৃত বক্তব্য যদি সঠিক হয়, নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য যথা ‘একটি ভোট পড়লেই নির্বাচন অংশ গ্রহণমূলক’ এবং ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার আনার দায়িত্ব আমার নয়’ ইত্যাদি অযাচিত বক্তব্য স্তবকতা ছাড়া আর কী হতে পারে?

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]