- মিনার রশীদ
- ২২ জুন ২০২১
২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি দৈনিক নয় দিগন্তে উপরোক্ত শিরোনামে আমার একটি কলাম ছাপা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করার পর বিএনপি নতুন একটি ফর্মুলা উপস্থাপনের কথা জাতিকে জানিয়েছিল। কিন্তু সেই ফর্মুলাটি আর দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে বিএনপির মহাসচিবসহ দু-একজনের মুখে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে শব্দটি শোনা গেলেও অজানা কারণে আবার বিএনপিই এটা ভুলে যায়। আমার সেই লেখার মূল অংশটি সবার বিবেচনার জন্য আবারো এখানে পেশ করছি।
‘আগামী পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। বিএনপি জোটকে শুধু সামনের একটা নির্বাচনের দাবি নয়, পরপর পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন জাতিসঙ্ঘের আওতায় অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে জনগণের সম্মুখে উপস্থিত হওয়া দরকার। তখন স্পষ্ট হবে এটা শুধু নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, দেশ ও দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্যই এই দাবিটি তোলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তাতে সামনের পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হলে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কাক্সিক্ষত একটা জায়গায় ফিরে আসবে বলে অনুমিত হয়। জনগণের সার্বিক সচেতনতায় তখন জবাবদিহির একটা কালচারও সমাজ ও প্রশাসনের সর্বস্তরে গড়ে উঠবে।
আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সুনাম ও দক্ষতার সাথে কাজ করছে। অন্যান্য দেশ থেকে কিছু পর্যবেক্ষক রেখে বাদবাকি জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যের ব্যবহারের মাধ্যমে এই কাজটি সহজেই করতে পারে জাতিসঙ্ঘ।
এই দেশটি একটি কলিসন কোর্সে রয়েছে। আমরা এখনই যদি একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তবে নির্দিষ্ট সময় পরে মারাত্মক বিস্ফোরণ বা সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও হয়ে পড়বে ইরাক, আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো কিংবা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কোনো জায়গা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে যদি জনগণের ক্ষোভ, হতাশা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, অনুভূতি প্রভৃতিকে প্রবাহিত করা না যায় তবে এ ধরনের বিস্ফোরণ অনিবার্য। গণতন্ত্রহীনতা মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, আমরা তা নিজের চোখে দেখছি। আবার গণতন্ত্রের কল্যাণে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে যে সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি হয়েছে তাও আমাদের চোখে পড়ছে।
বর্তমানে যে রাজনৈতিক বিশ্বাসই ধারণ করি না কেন, তখন আমরা কেউ এর পরিণাম থেকে আত্মরক্ষা করতে পারব না। একবার ওই পর্যায়ে চলে গেলে সেখান থেকে শত চেষ্টা করেও আর ফিরে আসতে পারব না। কাজেই যা করার এখনই সময়।
দেশের একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবে সবার কাছে নিবেদন, আসুন সময় থাকতে সবাই সজাগ হই। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের ১০ ফোঁড়ের সমান। একদিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি নামে কোনো দল হয়তো এ দেশে থাকবে না। কিন্তু দেশটিকে টিকে থাকতে হবে। আমার আপনার সামান্য ক্ষোভ, হতাশা, লোভ যেন ১৬ কোটি (২০১৬ সালে) আত্মা এবং তাদের আগত প্রজন্মকে মারাত্মক বিপদে না ফেলে। আজকে যে মহাপরাক্রমশালী পুলিশ বা আর্মি অফিসার আছেন, আগামী দিন হয়তো তারই কোনো রক্তের উত্তরসূরি ইরাক-সিরিয়ার অসহায় নারী ও শিশুর মতো বোমা বা গোলার আঘাতে জর্জরিত হবে। আমার আপনার রক্তের উত্তরসূরির কান্নায় বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হবে। কোনো সম্মিলিত বাহিনীর স্মার্টবোমা যত স্মার্ট হোক, তখন আওয়ামী লীগ আর বিএনপির উত্তরসূরি বা ঘরবাড়ির মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না।
আমাদের মানতে হবে যে, এই দেশটি যেমন আওয়ামী লীগের, তেমনিভাবে এই দেশটি বিএনপির, জাতীয় পার্টির, জামায়াতের, এই দেশটি অন্য সবার। এদের কাউকেই এই দেশ থেকে বের করে দেয়া সম্ভব হবে না। এমনকি জামায়াতের যে জনসংখ্যা রয়েছে তা শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সর্বসাকুল্য জনসংখ্যার সমান। এসব মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব হবে না। সবাইকে নিয়েই এ দেশে থাকতে হবে। সবাইকে নিয়ে থাকার ফর্মুলা বের করতে হবে। কোনো ক্রুদ্ধ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আদর্শ দিয়ে বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তা করতে গিয়ে শুধু এই সোনার দেশটিকে জাহান্নাম বানিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
এ ধরনের সর্বনাশা পরিণতি থেকে জাতির সুরক্ষার জন্য দেশের বিবেকবান ও সচেতন অংশকে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য জাতিসঙ্ঘের অধীনে আগামী পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলতে হবে। এ দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকারসহ সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সময় ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এর কোনো বিকল্প নেই।’
এই ছিল আমার আবেদন। এতদিন পর তরুণ নেতা ভিপি নুরের মুখে একই দাবি শুনে খুবই আশান্বিত হয়েছি। আশা করি আমাদের অন্য দলগুলো এগিয়ে এসে এই দাবিকে গণদাবিতে রূপান্তর করবে। মির্জা ফখরুলের মতো ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষও যুদ্ধের কথা ভাবা শুরু করে দিয়েছেন! এটা এখন অনেকটা রাজনৈতিক হুমকির মতো শোনালেও এটাই এ দেশের শেষ পরিণতি হতে পারে। সেই যুদ্ধের আঞ্জাম দেয়ার লোকের অভাব হবে না। বাংলাদেশ যেভাবে বিভিন্ন পরস্পর মুখোমুখি বিশ্বশক্তির নজরে পড়ে গেছে তাতে এ ধরনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রশ্ন আসতে পারে, জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তখনকার সরকার এবং প্রশাসন কেমন হবে? নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা ছিল সেসব জটিলতা থেকে এই ব্যবস্থাকে মুক্ত রাখতে হবে। কে নিরপেক্ষ আর কে নিরপেক্ষ নন- এই জটিল প্রশ্নে জাতির অনেক সময় ও শ্রম নষ্ট হয়েছে। এই দুর্বলতার হাত ধরেই এক-এগারো এসেছে। কাজেই ব্যক্তিকে নয়- প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ বানানোর চিন্তাভাবনা করতে হবে। রাজনীতি দিয়েই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে কখনোই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
এর জন্য নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের রূপরেখাও স্পষ্টভাবে লিখিত থাকতে হবে। তখন যিনি প্রেসিডেন্ট থাকবেন তিনিই হবেন সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। ১০ জন মন্ত্রী নিয়ে সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। তার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পাঁচটি মন্ত্রণালয় থাকবে প্রকৃত বিরোধী দলের হাতে- কোনো গৃহপালিত বিরোধীদলকে দিয়ে এই কাজ সম্ভব হবে না। এর ফলে এই সরকারও সাংবিধানিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী হবে। কারণ একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স সৃষ্টি করা হবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দিয়েই।
এই সরকারের মূল কাজ হবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা। কিভাবে প্রশাসনের রদবদল হবে সেটাও সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। যেমন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে এমন ১০ জন সচিব সরকারি দলের পছন্দে হলে বাকি ১০ জন বিরোধী দলের পছন্দে থাকতে হবে। ৬৪টি জেলার মধ্যে এক জেলার ডিসির নিয়োগ সরকারি দলের পছন্দে হলে সেই জেলার এসপির নিয়োগ হবে বিরোধী দলের পছন্দে বা সুপারিশে। অর্থাৎ সরকারি দল ও বিরোধী দল প্রত্যেকেই ৩২ জন ডিসি ও ৩২ জন এসপির নিয়োগে সুপারিশ করতে পারবে। একই ভাবে দেশের সব উপজেলার ইউএনও এবং ওসির নিয়োগ ফিফটি ফিফটি চয়েসে সম্পন্ন করা হবে। অর্থাৎ কোনো উপজেলার ইউএনওর নিয়োগ সরকারি দলের পছন্দে বা সুপারিশে করা হলে সেই উপজেলার ওসির নিয়োগ হবে বিরোধী দলের সুপারিশে!
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সেনাবাহিনীর একজন কর্নেলের নেতৃত্বে জেলা নির্বাচনী কমিটি এবং একজন মেজরের নেতৃত্বে সংসদীয় এলাকার কমিটি গঠন করা হবে। জেলা এবং উপজেলা কমিটিতেও ১০ জন করে সদস্যের পাঁচজন সরকারি দল থেকে এবং বাকি পাঁচজন বিরোধী দলের নেতাকর্মী থেকে বাছাই করা হবে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বা প্রতিশোধপরায়ণ কর্মকাণ্ড সীমিত রাখতে জাতিসঙ্ঘের সেই বাহিনীকে নির্বাচনের পর ছয় মাস রাখা হবে। ফলে ওবায়দুল কাদেরদের সেই ভীতি বা শঙ্কাটিও (নির্বাচনে ফেল করলে অর্জিত সম্পদ নিয়ে উড়াল দিতে হবে!) এই মেকানিজমে দূর করা সম্ভব হবে।
স্পষ্টতই বুঝতে পারছেন, উপরের প্রস্তাবটি কোনো বিশেষ দলকে ক্ষমতায় এনে আজীবন সেই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নয় বরং এই সিস্টেম চালু হলে প্রত্যেকটি দলে সৎ ও যোগ্য লোকগুলো সামনে এগিয়ে আসবেন। এর মাধ্যমে দেশ ও জাতিও রক্ষা পাবে সম্ভাব্য মহাবিপর্যয় থেকে।
[email protected]